top ad image
top ad image
home iconarrow iconবিশ্ব রাজনীতিarrow iconফিচার

ইতিহাস

রানি আর্টেমিসিয়ার বীরত্বগাঁথা

রানি আর্টেমিসিয়ার বীরত্বগাঁথা
রণাঙ্গণে রানি আর্টেমিসিয়ার

ইতিহাসের পাতা জুড়ে পুরুষদের দাপটে যেন যুদ্ধের মাঠগুলো কেবলই রক্ত ও শক্তির খেলা। কিন্তু সেই দৃঢ় বৃত্তের মাঝখানে এক নারী উঠে এসেছিলেন যিনি ছিলেন একজন সম্রাজ্ঞী, এক দক্ষ সেনানায়ক, এক বুদ্ধিদীপ্ত কূটনীতিবিদ—তিনি হলেন হেলিকার্নেসাসের রানী আর্টেমিসিয়া-১। পারস্য ও গ্রীসের মধ্যেকার বিখ্যাত যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা আজও ইতিহাসপ্রেমীদের মুগ্ধ করে।

রানী আর্টেমিসিয়ার জন্ম ৫২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে, বর্তমান তুরস্কের উপকূলীয় শহর হেলিকার্নেসাসে (আজকের বোডরেম)। তাঁর পিতা ছিলেন স্থানীয় রাজবংশের সদস্য লাইগাডিমিস এবং মা ক্রিট দ্বীপের অধিবাসী। সে সময় হেলিকার্নেসাস ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনস্থ একটি করদ রাজ্য, শাসন করছিলেন সম্রাট প্রথম দারিয়ুস।

আর্টেমিসিয়া তরুণ বয়সেই বিয়ে করেন হেলিকার্নেসাসের তৎকালীন রাজাকে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর স্বামী মারা যান। তখন তিনি নাবালক পুত্র পিসিন্ডেলিসের অভিভাবক হিসেবে রাজ্যের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। একদিকে রাজ্যের ভার, অন্যদিকে রাজদরবারে পুরুষশাসিত পরিবেশ—এই দুইয়ের মাঝে তিনি তৈরি করেছিলেন নিজের এক স্বতন্ত্র অবস্থান।

৪৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট দারিয়ুস গ্রীস আক্রমণ করেন, তবে ম্যারাথনের যুদ্ধে হেরে পিছু হঠেন। সেই কলঙ্ক ঘোচাতে তাঁর পুত্র প্রথম জার্সেস বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে গ্রীস আক্রমণের পরিকল্পনা করেন দশ বছর পর। এই অভিযানে পারস্যের অনুগত সকল রাজ্যকে সৈন্য ও নৌ-জাহাজ সরবরাহের আদেশ দেওয়া হয়। হেলিকার্নেসাসও বাদ যায়নি।

রানী আর্টেমিসিয়া পারস্যের পক্ষে অংশ নেন এবং নিজের রাজ্য থেকে ছয়টি যুদ্ধজাহাজসহ মোট ৭০টি রণতরী জার্সেসের নৌবহরে পাঠান। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেই সেই বহরের একজন কমান্ডার হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। সমগ্র পারস্য বাহিনীতে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী সেনাপতি। হেরোডোটাসের বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁর নেতৃত্বে থাকা জাহাজগুলো ছিল অন্যতম শক্তিশালী এবং সুসজ্জিত।

৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইউবোয়া দ্বীপের উপকূলে আর্টেমিশিয়ামের যুদ্ধে গ্রীক ও পারস্যের প্রথম বড়সড় নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই লড়াই তিন দিন ধরে চলে, আর্টেমিসিয়াও অংশ নেন নিজ হাতে। এই যুদ্ধে গ্রীকরা ভালো লড়াই করলেও থার্মোপাইলির পরাজয়ের খবর পেয়ে তারা পিছু হটে। আর্টেমিসিয়ার সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তা দেখে গ্রীকরা তার মাথার উপর ১০,০০০ দ্রাখমা পুরস্কার ঘোষণা করে।

সালামিস প্রণালীতে গ্রীকদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে পারস্য বাহিনী। জার্সেস যুদ্ধের আগে তার কমান্ডারদের মতামত চেয়েছিলেন। সবাই যুদ্ধ করার পক্ষে মত দিলেও আর্টেমিসিয়া ভিন্ন কথা বলেন। তিনি সরাসরি বলেন, “গ্রীকদের নৌযুদ্ধের দক্ষতা আমাদের চেয়ে বেশি। সালামিসে যুদ্ধে জড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ হবে।”

এমন স্পষ্ট ও বিচক্ষণ পরামর্শে অনেকেই ভাবেন জার্সেস হয়তো তাকে শাস্তি দেবেন। কিন্তু উল্টোভাবে, জার্সেস তার সাহসী ও যুক্তিসঙ্গত বক্তব্যে খুশি হন। যদিও শেষমেশ যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ফলাফল হয় পারস্যের জন্য বিপর্যয়কর।

সালামিসের যুদ্ধে আর্টেমিসিয়া অসাধারণ কৌশল ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি শত্রুদের চোখে ধোঁকা দিতে নিজের মিত্র এক জাহাজকে আঘাত করেন, যাতে গ্রীকরা তাকে ভুলবশত নিজেদের পক্ষে মনে করে পিছু হটে যায়। এই দৃশ্য জার্সেস দূর থেকে দেখে মুগ্ধ হন। তিনি বলেন, “আমার পুরুষ সেনারা লড়াই করছে নারীদের মতো, আর এই নারী লড়ছে পুরুষদের মতো।”

যুদ্ধ শেষে যখন পরাজয় স্পষ্ট, তখন জার্সেস নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছিলেন। সেনাপতি মার্ডোনিয়াস প্রস্তাব দেন গ্রীসে হামলা চালানোর, আর নিজে থেকে সেনা পরিচালনার অনুমতি চান। জার্সেস দোটানায় ছিলেন।

এই অবস্থায় আবার হাজির হন আর্টেমিসিয়া। তিনি বলেন, “মার্ডোনিয়াস যদি সফল হন, কৃতিত্ব আপনার। আর যদি ব্যর্থ হন, ক্ষতি কম—আপনি তাতে জড়িত হবেন না। গ্রীকরা আপনাকে ছুঁতেও পারবে না।” এই কূটনৈতিক কৌশলে জার্সেস আশ্বস্ত হন এবং মার্ডোনিয়াসকে সৈন্যসহ রেখে নিজে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।

হেরোডোটাস, পসেনিয়াস, পলিনিয়াসসহ অনেক প্রাচীন ইতিহাসবিদ আর্টেমিসিয়ার বর্ণনা রেখেছেন। কেউ কেউ তাকে “জলদস্যু” বললেও, নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনেস তাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেন। একথা বলা যায়, তিনি ছিলেন প্রাচীন বিশ্বের এক ব্যতিক্রমী নারী চরিত্র—নেতৃত্বে দক্ষ, কৌশলে নিখুঁত, এবং পুরুষদের দাপটের মাঝেও নিজের জায়গা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম।

৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পর আর্টেমিসিয়ার জীবন নিয়ে ইতিহাসে তেমন নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। কিছু কাহিনি বলেছে তিনি প্রেমে পড়ে আত্মহত্যা করেন, আবার কেউ বলেন তিনি গ্রীসে ফিরে গিয়ে নিভৃতে জীবন কাটান। তবে এটা স্পষ্ট, ইতিহাস তাঁকে ভুলে যায়নি।

স্পার্টার বাজারে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ চার্লস নিউটন হেলিকার্নেসাসের এক সমাধিতে খুঁজে পান একটি পাত্র, যেখানে জার্সেসের সিল ছিল—সম্ভবত তিনি আর্টেমিসিয়াকে উপহার দিয়েছিলেন।

রানী আর্টেমিসিয়া-১ ছিলেন এক অনন্য ইতিহাসনায়িকা। একদিকে শাসন, অন্যদিকে যুদ্ধ; কখনও পরামর্শদাতা, কখনও সম্মুখ যোদ্ধা—তাঁর জীবনচরিত ইতিহাসের পাতায় অনুপ্রেরণার এক অমল ছাপ রেখে গেছে। নারী নেতৃত্ব, সাহসিকতা এবং কূটনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতীক হিসেবে আর্টেমিসিয়া-১ আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। গ্রীক ও পারস্য—দুই সংস্কৃতির ইতিহাসেই তিনি সম্মানের সঙ্গে স্থান পেয়েছেন, যা তাঁকে করে তুলেছে কালজয়ী।

r1 ad
top ad image