ইতিহাস

উপমহাদেশে পর্তুগিজ জলদস্যুদের তাণ্ডব

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১৩: ৪৩
পর্তুগিজ জলদুস্যদের তাণ্ডব।

ভারতীয় উপমহাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ইতিহাস যতটা বাণিজ্যের, ঠিক ততটাই দখল, লুণ্ঠন আর রক্তপাতেরও। এই ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর অধ্যায় হলো পর্তুগিজ জলদস্যুদের তাণ্ডব। আজ আমরা যখন ‘পর্তুগিজ’ শব্দটি শুনি, তখন হয়তো মনে আসে ফুটবল, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কিংবা লিসবনের পুরনো শহরের কথা। কিন্তু কয়েকশ বছর আগে এই ‘পর্তুগিজ’ শব্দটি উপমহাদেশের বহু মানুষের কাছে ছিল এক আতঙ্কের নাম। তারা শুধু বণিক বা নাবিক ছিল না—তারা ছিল আগ্রাসী, ধর্মান্তরকারী, বন্দী শিকারি, আর কখনো কখনো নির্মম খুনি। উপমহাদেশের ইতিহাসে তাদের দখলদারি আর জলদস্যুতার ছাপ আজও মুছে যায়নি।

১৫০০ সালের আশপাশে যখন ইউরোপীয় বণিকেরা জলপথে এশিয়ায় পৌঁছাতে থাকে, তখন ভারতের পশ্চিম উপকূলে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করে পর্তুগিজরা। ১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামা কালিকটে (বর্তমান কেরালা) এসে পৌঁছান, আর এরপরই শুরু হয় পর্তুগিজদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় সামুদ্রিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের অভিযান। তবে এটি শুধুই বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল না, বরং ছিল এক নিপীড়নমুখী সাম্রাজ্য বিস্তারের শুরু। ১৫০৫ সালে ফ্রান্সিসকো দে আলমেইদাকে ‘ভাইসরয়’ নিযুক্ত করে পর্তুগিজ সরকার। তার পর থেকেই গোয়ার আশপাশের এলাকায় তাঁরা গড়ে তোলে দুর্গ, জাহাজঘাঁটি, গির্জা ও বসতি। এর পাশাপাশি, আরেকটি জিনিস তারা ছড়িয়ে দেয়—ভয়।

পর্তুগিজ নাবিকদের অনেকেই ছিল মূলত দস্যু, যাদের দৃষ্টি ছিল উপমহাদেশের উপকূলবর্তী গ্রাম, মসজিদ, মন্দির ও জলপথের ওপর। তারা নিয়মিতভাবে আরব, গুজরাটি ও বঙ্গীয় জাহাজগুলো আক্রমণ করত। এদের একটি বড় অংশ বিশেষত হজ যাত্রীদের বহনকারী জাহাজকে টার্গেট করত। পর্তুগিজরা জানত, এই জাহাজে প্রচুর ধনসম্পদ ও অসহায় যাত্রী থাকে, যাদের আক্রমণ করলে প্রতিরোধ খুব কমই পাওয়া যাবে। তারা অনেক সময় এসব জাহাজ দখল করে যাত্রীদের হত্যা করত অথবা বন্দি করে মোটা মুক্তিপণ দাবি করত।

১৭শ শতকের ব্রিটিশ গবেষক ও পর্যটক স্যর উইলিয়াম হকিন্স তাঁর ভ্রমণ বর্ণনায় লিখেছেন, “পর্তুগিজদের আচরণ ছিল জলদস্যুর চেয়েও নিকৃষ্ট। তারা ধর্মের নামে হত্যা করত, নারীদের অপহরণ করত, আর যেসব হিন্দু-মুসলিম ধর্মান্তর হতে রাজি হতো না, তাদের আগুনে পুড়িয়ে দিত।” সুরাট, দমন, দিউ কিংবা চিটাগাং—এই সব উপকূলবর্তী শহরগুলোর মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে এই ভয়াল তাণ্ডবের শিকার ছিল।

বাংলার উপকূলেও পর্তুগিজদের দখলদারি পৌঁছেছিল। ১৫৩৭ সালে তারা চট্টগ্রামের কাছে বসতি স্থাপন করে এবং তাকে বলে ‘পোর্তো গ্র্যান্ডে’। তারা এখান থেকে স্থানীয় রাজা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জোট বেঁধে নিজেরা বাণিজ্য চালাত, আবার সুযোগ পেলে জলদস্যুতাও করত। তাদের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ উঠেছে যে তারা শিশু অপহরণ করে বিক্রি করত, হিন্দু-মুসলিম তরুণীদের জোর করে ধর্মান্তর করত এবং যেসব বণিক বা জাহাজ তাদের বশ্যতা স্বীকার করত না, সেগুলো আক্রমণ করত। এমনকি, তারা অনেক সময় বাংলার নদীপথে ঢুকে গিয়ে গভীরে পর্যন্ত লুটতরাজ চালাত।

বিখ্যাত ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ রিচার্ড মাক্সওয়েল ইটন তাঁর বই The Rise of Islam and the Bengal Frontier -এ লিখেছেন, “পর্তুগিজ জলদস্যুরা চট্টগ্রামের উপকূলজুড়ে এক ধরনের অঘোষিত সন্ত্রাস কায়েম করেছিল। তাদের কেউ রুখে দাঁড়াতে পারত না, কারণ তাদের পেছনে ছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও অস্ত্রশস্ত্র।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, “এদের অনেকেই ধর্মান্তরিত মানুষদের নিজেদের বাহিনীতে যুক্ত করত, ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বিভাজন তৈরি হতো।”

পর্তুগিজরা শুধু জলপথেই দস্যুতা করত না, তারা স্থলভাগেও হানা দিত। বাংলার বহু অঞ্চলে তারা বাগানে আগুন লাগাত, গোডাউনে ঢুকে ধনসম্পদ লুট করত এবং অনেক সময় স্থানীয় শাসকের সেনা বা প্রশাসনকে ঘুষ দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেত। তাদের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল—যার কাছে তারা প্রতিরোধ পেত না, তাকে তারা ভয়ানকভাবে নিপীড়ন করত। আবার যারা প্রতিরোধ করত, তাদের সঙ্গে কখনো কখনো আপস করে নেওয়ার কৌশলও তারা রপ্ত করেছিল।

তবে পর্তুগিজদের এই তাণ্ডব চিরকাল স্থায়ী হয়নি। মুঘল সাম্রাজ্য যখন শক্তিশালী হয়, তখন তারা ধীরে ধীরে পর্তুগিজ জলদস্যুদের প্রতিহত করতে শুরু করে। সম্রাট শাহজাহানের আমলে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৬ সালে পর্তুগিজদের চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করেন। এই অভিযানের মাধ্যমে পর্তুগিজদের প্রায় দেড় শতকের দখলদারি ও সন্ত্রাসের অবসান ঘটে। চট্টগ্রাম আবার বাংলার অধীনে ফিরে আসে।

কিন্তু এর মানে এই নয় যে পর্তুগিজরা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তারা তখন পশ্চিম ভারতে, বিশেষত গোয়া, দমন ও দিউতে নিজেদের ঘাঁটি শক্ত করে রাখে এবং সেখানে থেকে তারা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। গোয়ায় তারা কুখ্যাত ‘ইনকুইজিশন’ চালু করে, যার মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলিমদের জোর করে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তর করানো হতো, তাদের ধর্মীয় চিহ্ন ধ্বংস করা হতো, এমনকি কোনো কোনো সময় শাস্তিস্বরূপ জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। এই ইনকুইজিশন এতটাই নির্মম ছিল যে, ইতিহাসবিদদের অনেকেই একে ইউরোপীয় মধ্যযুগীয় নির্যাতনের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

পর্তুগিজদের এই আগ্রাসনের পেছনে শুধু বাণিজ্য নয়, ছিল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের নেশা। তারা নিজস্ব ধর্ম, রীতি ও ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল উপমহাদেশের ওপর। ব্রিটিশ গবেষক জেফরি পার্কার তাঁর বই Global Interactions in the Early Modern Age -এ লিখেছেন, “পর্তুগিজরা ছিল প্রথম ইউরোপীয় শক্তি যারা আধুনিক উপনিবেশিক নীতির বাস্তব চর্চা শুরু করে। বাণিজ্য, ধর্ম ও দখল—এই তিনের সমন্বয়েই তারা একটি সহিংস ও বিভাজনমুখী শাসন ব্যবস্থা তৈরি করেছিল।”

আজ আমরা যখন উপমহাদেশে ব্রিটিশ বা মুঘলদের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করি, তখন পর্তুগিজদের অবদান বা দখলদারি যেন প্রায় উপেক্ষিতই থেকে যায়। অথচ, ইতিহাসের এই রক্তাক্ত পর্বটি শুধু ভয়াবহতা দিয়ে নয়, বরং আমাদের উপকূলীয় রাজনীতি, ধর্মীয় বিভাজন, সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কৃতির বিন্যাসের দিক থেকেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

আজও গোয়ায় গেলে পর্তুগিজ স্থাপত্য, ভাষার ছাপ বা নামকরণ দেখা যায়। বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কয়েকটি পুরনো গির্জা, ভাষার শব্দভাণ্ডার বা স্থাননামেও পর্তুগিজ প্রভাবের ছায়া রয়ে গেছে। কেউ কেউ বলে থাকেন, ‘ফিরিঙ্গি’ শব্দটির মূলত উৎস পর্তুগিজ বণিকদের মধ্য থেকেই।

এই ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ কেবল বাণিজ্য বা উন্নয়ন আনেনি, আনেছিল ভয়, নিপীড়ন ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন। পর্তুগিজ জলদস্যুদের তাণ্ডব সেই আগ্রাসনের এক ভয়াবহ নিদর্শন, যা ইতিহাসের পাতা থেকে আজও আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। ইতিহাসের ভুলগুলো মনে রাখাই ভবিষ্যতের পথকে নিরাপদ করে তোলে।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়াকে ট্রাম্পের ৫০ দিনের আল্টিমেটাম

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়াকে ৫০ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন। হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেছেন, এর মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধান না হলে মস্কোর ওপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।

১ দিন আগে

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ৭৮

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরতা থামছেই না। যুদ্ধবিরতি আলোচনার মধ্যেই সেখানে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে তারা। এতে একদিনে কমপক্ষে আরও ৭৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

২ দিন আগে

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ কেন হয়েছিল?

এই যুদ্ধ কেন হয়েছিল তা বুঝতে গেলে আমাদের উনিশ শতকের মাঝামাঝি ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একবার ঝালিয়ে নিতে হবে। ১৭০৭ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়।

২ দিন আগে

ট্রাম্পের শুল্কারোপ নীতি ও বাংলাদেশি পণ্যের বাণিজ্য

২ দিন আগে