বিবিসি বাংলা
গত বছরের ৫ই অগাস্ট বাংলাদেশে ক্ষমতার নাটকীয় পটপরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে ধরনের আমূল পরিবর্তন এসেছে তা এক কথায় অভাবিত। বহুদিনের মিত্র দুটো দেশের সরকার এখন দৃশ্যতই পরস্পরকে সন্দেহ ও অবিশ্বাস করছে, ঠিক শত্রুতা না হলেও সম্পর্ক গড়াচ্ছে বিদ্বেষের দিকে।
বাংলাদেশের পথেপ্রান্তরে 'দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা' স্লোগানের ধ্বনি আর পাশাপাশি ভারত জুড়ে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা কিংবা কথিত বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান – দুটো দেশের মাঝে আচমকাই যেন অনতিক্রম্য একটা দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে।
যে বাংলাদেশকে ভারত তাদের 'প্রতিবেশ' বা নেইবারহুডে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে দাবি করতো – সে দেশে এখন ভারতের ভিসা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ, বাংলাদেশকে দেওয়া বিভিন্ন বাণিজ্য সুবিধাও একের পর এক বাতিল, সে দেশে অবকাঠামো, জ্বালানি-সহ বিভিন্ন খাতে ভারতের বহু প্রকল্পের কাজও অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি হয়ে আছে।
দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, বিডিআর ও বিএসএফের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষ পর্যন্ত ঘটছে হামেশাই – কখনো আবার তাতে যোগ দিচ্ছেন দু'দিকের স্থানীয় গ্রামবাসীরাও।
দু'দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানও একরকম স্তব্ধ, এমন কি পর্যটন বা চিকিৎসা সফরও এখন সাধারণের নাগালের বাইরে।
বস্তুত ভারত এটাও পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তারা ন্যূনতম প্রয়োজনের বাইরে পুরোদস্তুর কোনও 'এনগেজমেন্টে' যেতেও আগ্রহী নয় – যে কারণে গঙ্গা চুক্তির নবায়ন কিংবা অভিন্ন নদীগুলোর জল ভাগাভাগির মতো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও থমকে আছে।
বস্তুত দু'দেশেই পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা এটা মানেন, বাংলাদেশে অন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত এক বছরে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ঠিক বন্ধুত্বপূর্ণ বা স্বাভাবিক বলা চলে না কোনও মতেই।
'ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ' বা কাজ চালানোর মতো সম্পর্কটা হয়তো কোনওক্রমে টিঁকে আছে, কিন্তু পারস্পরিক আস্থা বা ভরসার জায়গাটা যে হারিয়ে গেছে এটা বোঝার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হওয়ারও কোনো দরকার নেই।
আর সম্পর্কের এই অবনতির ক্ষেত্রে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক - সব ধরনের মাত্রা বা 'ডায়মেনশন'ই কিন্তু আছে।
দিল্লির দিক থেকে এই ফ্যাক্টরগুলো ঠিক কীভাবে কাজ করেছে – অথবা ঠিক কোন কোন দৃষ্টিকোণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে, এই প্রতিবেদনে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে সেটাই।
'সম্পর্কটা ছিল একজন মাত্র ব্যক্তির সঙ্গে'
যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মাত্র এক বছর আগেও দুই দেশের সরকার 'সোনালি অধ্যায়' বলে বর্ণনা করত, সেটা এত দ্রুত কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়লো, দিল্লিতে এখনও কান পাতলেই তার নানা ব্যাখ্যা শোনা যায়।
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটা হল, আসলে ভারতের এই তথাকথিত সুসম্পর্কটা ছিল একজন ব্যক্তি বা একটি দলের সঙ্গে – পুরো দেশটার সঙ্গে নয়।
দিল্লিতে পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ তথা ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তর বলতে কোনও দ্বিধা নেই, শুধু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রিজম দিয়ে বাংলাদেশকে দেখেছিল ভারত – আর তার জন্যই দিল্লিকে আজ চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
তার কথায়, "ভারতের একটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল আওয়ামী লীগের সাথে – এবং শেখ হাসিনার সাথে অফ কোর্স। তারপরে উনি যখন ২০০৯ জানুয়ারিতে ইলেক্টেড হয়ে আসলেন, সেই যে কাজটা শুরু করেছিলেন ভারতের সাথে সেটা ও দেশের কোনও গভর্নমেন্টই এর আগে করতে পারেনি।"
তিনি আরো জানাচ্ছেন, শেখ হাসিনা শুধু ভারতের 'সিকিওরিটি কনসার্ন'গুলোই অ্যাড্রেস করেননি, ভারত যেভাবে ট্রেড বা কানেক্টিভিটি প্রোজেক্টগুলো চেয়েছিল সেটাও তার মতো করে আগে কোনও সরকার করেনি।
কিন্তু এই সুবিধা পেতে গিয়ে ভারত বাংলাদেশের ভেতরে কী অন্তর্দ্বন্দ্ব (ক্রস কারেন্টস) তৈরি হচ্ছে কিংবা শেখ হাসিনার কার্যকলাপ নিয়ে জনরোষ সৃষ্টি হচ্ছে কি না, সে দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।
"মানে একদম একজনের সাথেই শুধু কাজ করছি, কিন্তু সে কী করছে সেটাকে ইন্টারনাল ম্যাটার বলে ইগনোর করে যাচ্ছি – আমরা শুধু দেখছি আমাদের সাথে তো সম্পর্ক ভাল আছে, বাকিটা আমাদের কিছু যায় আসে না।"
"কিন্তু এই পুরো জিনিসটার একটা ড্রাস্টিক ট্রান্সফর্মেশন হলো ফিফথ অগাস্টে। আর ঠিক তার আগে এটাও আমরা দেখেছি একটা চরম বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে – আর তাদের স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে ভারতের বিরুদ্ধেও", বিবিসিকে বলছিলেন শ্রীরাধা দত্ত।
এরপর যখন সেই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভারতেই আশ্রয় ও আতিথেয়তা পেলেন, ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভটা তাতে আরও বাড়লো।
সেই জায়গা থেকেই বাংলাদেশে যে 'একটা অদ্ভুত রাগ' ভারতের ওপর তৈরি হয়েছিল – আজকের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ঠিক সেটারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই বিশেষজ্ঞ।
এত বিনিয়োগ, এত স্টেক – তবুও কেন অস্বস্তি?
কিন্তু যে বাংলাদেশে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ জড়িয়ে – এবং সেখানে বিভিন্ন সেক্টরে ভারতের যে বিপুল বিনিয়োগ – সেখানে তো অন্তত এইসব সামরিক বা অর্থনৈতিক কারণেও দিল্লির তরফে একটা মসৃণ সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত ছিল?
ভারতের অর্থনীতিবিদ ও আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি-র বিশেষজ্ঞ ড: প্রবীর দে মনে করেন, ভারত যে বাংলাদেশে তাদের এই 'ইন্টারেস্ট'গুলো খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে তা নয় – তবে গোটা বিষয়টাকে একটা 'পজ' বা সাময়িক বিরতির মোডে রাখা হয়েছে।
দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আরআইএস-এর এই অধ্যাপক বিবিসিকে বলছিলেন, "না, সম্পর্কটা বিগড়ে যায়নি। আমি সেটা বলবো না। সম্পর্কটা আছে ... কিন্তু ব্যাপারটা এরকম যে দুটো বন্ধুর মধ্যে এখন কিছুদিন কথাবার্তা হচ্ছে না।"
"অন্যভাবে বললে, সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু আমরা ঠিক করেছি যে এখন কিছুদিন অন্যভাবে থাকা যাক। আমরা এখন ওয়েট করে আছি, বিশেষ করে ইন্ডিয়ার দিক থেকে, যে বাংলাদেশ কখন 'ফার্স্ট মুভ'টা করবে।"
তিনি আরো জানাচ্ছেন. এই 'ফার্স্ট মুভ' – বা সম্পর্কটা আবার স্বাভাবিক করতে কোনও এক পক্ষের দিক থেকে ইঙ্গিত - সেটা বোধহয় বাংলাদেশে নির্বাচনের স্পষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা হলে বা একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পরই হবে বলে ভারতের ধারণা।
"আসলে বাংলাদেশ ও ভারত দুজনে দুজনকে নিয়েই থাকতে চায় – সেটাই স্বাভাবিক, কারণ নেইবার আমরা। প্রতিবেশীকে তো আর পাল্টানো যায় না।"
"কিন্তু এবারে যেটা হয়েছে যে একটা অদ্ভুত দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে ... দুটো দেশের মধ্যে যে রিলেশনটা একাত্তর বা তারও আগে থেকে তৈরি হয়েছিল, যেটা সরকার পরিবর্তন হলেও ভেঙে যায়নি – এবারে সেখানে আঘাতটা লাগানো হচ্ছে। কুড়ালটা ওখানে মারা হয়েছে আর কী।", বলছিলেন প্রবীর দে।
তার কথায় স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যেভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে এবং বিভিন্ন কৌশলগত বা সামরিক ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার পথে এগোচ্ছে ভারতের পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে কয়েকটা 'রেড লাইন' আছে পাকিস্তান অবশ্যই তার একটা – আর সেই অস্বস্তিকর সীমানাটা অতিক্রম করা হয়েছে বলেই ঢাকার সঙ্গে এই মুহুর্তে দিল্লির সহজ সম্পর্ক সম্ভব নয়, এমনটাও মনে করছেন দিল্লিতে অনেক বিশ্লেষক।
ছায়া ফেলছে রাজনৈতিক যে কারণ
সম্পর্কের অবনতির ক্ষেত্রে ভারতের শাসক দল বিজেপি আবার যে রাজনৈতিক ব্যাখ্যাটা দিচ্ছে তা হল – বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতীয় মিডিয়ার খবরকে যতই ফেক নিউজ বা অতিরঞ্জন বলে উড়িয়ে দিন – সেখানে হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অজস্র অভিযোগ গত এক বছরে ভারতে যে পরিমাণ গুরুত্ব পেয়েছে এবং ভারত সরকার এই ইস্যুতে নিয়মিত যেভাবে কঠোর বিবৃতি দিয়েছে – সেটা তার আগে সাম্প্রতিককালে কখনোই দেখা যায়নি।
ভারতে অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন, পাশের মুসলিম-প্রধান দেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের এই সব ঘটনাকে ভারতের ক্ষমতাসীন দল খুব সুকৌশলে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে – এবং সেখানে সম্পর্কটা এখন স্বাভাবিক করার তাগিদ অন্তত ভারতের দিক থেকে থাকার কথা নয়।
তার ওপর আর মাত্র আট-দশ মাসের মধ্যে (২০২৬ মার্চ-এপ্রিল) পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন, যে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য বিজেপি বহুদিন ধরেই মরিয়া।
ভারতের অভ্যন্তরে আসন্ন এই নির্বাচনের বাস্তবতাও সম্ভবত ভারতের শাসক দলের বৈদেশিক নীতিকে প্রভাবিত করছে।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির নতুন প্রেসিডেন্ট তথা দলের পার্লামেন্টারিয়ান শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য কোনও রাখঢাক না করেই বলছেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দুর্দশার বিষয়টি ভারতের পক্ষে কিছুতেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয় – তাই তারা বিষয়টি নিয়ে সরব হচ্ছেন।
বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, "যে ঘটনা বাংলাদেশে ঘটছে, তাতে একজন পশ্চিমবঙ্গ-বাসী হিসেবে – বা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের এপার বাংলা-ওপার বাংলার যে সম্পর্ক – তা থেকে একটা অদ্ভুত মানসিকতা মনে হচ্ছিল, যে এটা পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থায় আবার ফিরে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে।"
"এবং এই অত্যাচারটা বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে আজকে থেকে চলছে না – অত্যাচারটা কিন্তু শেখ হাসিনার সময়েও হয়েছে", জানাচ্ছেন তিনি।
এখানে বাংলাদেশ সরকারের বা সে দেশের সিভিল সোসাইটির অবস্থানকেও একটা 'ডিনায়াল মোড' বলে বর্ণনা করছেন তিনি।
"ঢাকা শহরে কিছু মানুষ আছেন যারা বলেন 'আমরা খুব ভালো আসি, আমাদের কোনো অসুবিধা নাই – না না এই সমস্ত গুজব' ... কিন্তু গ্রামগঞ্জে যে অত্যাচার হচ্ছে সেটার খবর তো আমরা পাচ্ছি", বলছিলেন শমীক ভট্টাচার্য।
"আর একটা হচ্ছে, এই যে বিনা যুদ্ধে ভারত দখলের একটা চক্রান্ত চলেছে দীর্ঘদিন ধরে – যে 'চিকেন নেকে'র ওখানে ... ওটাকে কেটে নাও ... তো এই বিষয়গুলো আমাদের তো একটু চিন্তাভাবনার মধ্যে রাখা উচিত।"
ফলে সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে বাকি ভারতের সংযোগের সূত্র যে শিলিগুড়ির কাছে সরু করিডর, তার 'ভালনারেবিলিটি' নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্যও যে ভারত ভালভাবে নিচ্ছে না – সেই আভাসও ছিল পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতির গলায়।
সম্পর্ক কি আবার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব?
দিল্লিতে অনেকে আবার বিশ্বাস করেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখান থেকেও আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে – যদি আবার দুই দেশ অপরের বিশেষ প্রয়োজনটাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়।
যেমন ভারতের বেশি দরকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, বাংলাদেশের চাই জল।
উভয় দেশ যদি পরস্পরের এই অগ্রাধিকারটা উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে সম্পর্কে অগ্রগতি হওয়া সম্ভব বলেই অনেকে মনে করছেন।
পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তর কথায়, "আমরা (বাংলাদেশের) সব জায়গাতেই দেখি, সোশ্যাল মিডিয়াতে বা অন্য কোথাও – অসম্ভব একটা অ্যান্টি-ইন্ডিয়া রেটোরিক চলে।"
"এটা তো নিশ্চই সেখানে ইয়ুথরাই করে, কারণ ওদের একটা খুব বিতৃষ্ণা দাঁড়িয়ে গেছে, অ্যাবাউট ইন্ডিয়া। তো সেই জায়গাটা আমাদের পক্ষে বোধহয় একদম নর্মাল করা ... কঠিন, কিন্তু বোধহয় অসম্ভব নয়।"
তার যুক্তি হলো, বাংলাদেশের কাছে যেহেতু সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যু জল – সেখানে নদীর সম্পদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারলেই সম্পর্কে ম্যাজিক ঘটানো সম্ভব।
"যেমন ধরুন তাদের কিছু কিছু কনসার্ন আছে, আমি যেটা বিশ্বাস করি – যেমন ওয়াটার। ওটাতে কেন ইন্ডিয়া প্রোগ্রেস করেনি, কেন ওটা নিয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি?"
"সেই জায়গাগুলো যদি একটু দেখা যেত – তাহলে আমার মনে হয় ওদের কাছেও কিছু ইতিবাচক বার্তা পাঠাতে পারতাম।"
"এটা তো সত্যি, আমাদের সিকিওরিটি আমাদের কাছে প্রায়োরিটি, কিন্তু ওদের কাছে তো পানির ভাগাভাগি বা ওয়াটার শেয়ারিং-টা প্রায়োরিটি। সেটাতে আমরা একদমই কিছু করিনি।"
"আর যখন চায়না একটা প্রোপোজাল দিল তিস্তার ম্যানেজমেন্টের, তাতে রেগে গিয়ে বললাম না না ওটা আমরা করবো। কিন্তু আমরা কি এগিয়েছিলাম? তাও তো করিনি, না", বেশ হতাশার সুরেই বলেন শ্রীরাধা দত্ত।
অর্থনৈতিক স্বার্থই কি রূপোলি রেখা?
এই জটিল বিতর্কে আর একটা মতবাদ হলো, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং বাণিজ্যিক বাস্তবতাই দুই প্রতিবেশীকে আবার কাছাকাছি আনতে পারে – যেটা অন্য আর কোনও ফ্যাক্টর সেভাবে পারবে না।
আগামী বছর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হচ্ছে – কিন্তু এই 'প্রোমোশনে'র সঙ্গে সঙ্গেই কোটা-সহ বেশ কিছু পুরনো বাণিজ্য সুবিধা বাতিল হতে যাচ্ছে, অবধারিতভাবে আসতে চলেছে নতুন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ।
ভারতে কোনও কোনও বিশেষজ্ঞর বক্তব্য, এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দরকার ভারতকে।
অর্থনীতিবিদ প্রবীর দে-র কথায়, "সামনের বছর, মানে ২০২৬-এ বাংলাদেশ এলিভেট করছে ডেভেলপিং কান্ট্রি হিসেবে। এখন সেই 'থ্রাস্ট' ওদের দরকার একটা ... সেই থ্রাস্টটা পেতে গেলে ... মানে একটা ফ্লাইটকে, প্লেনকে টেক-অফের সময় ওপরে উঠতে গেলে যেমন একটা থ্রাস্ট দরকার, এখানেও ঠিক তাই।"
"নেক্সট ইয়ারে ডেভেলপিং কান্ট্রিতে ওনারা এলিভেট করার পর সেখান থেকে যদি তারপরে ফ্লাই করতে হয়, মানে লং টাইম অ্যাজ আ ডেভেলপিং ইকোনমি – তাহলে বাংলাদেশের দরকার ইন্ডিয়াকে, ভারতবর্ষকে।"
"তো এছাড়া কে ওনাদের হেল্প করতে পারবে? অন্য কোনো কান্ট্রি তো সেভাবে পারবে না।"
ভারতের এই সম্ভাব্য সহযোগিতার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তিনি টেনে আনছেন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের কথা।
"ধরুন, ওনারা যে পোর্টটা তৈরি করছেন মাতারবাড়িতে, একটা বড় ডিপ সি পোর্ট ... সেই পোর্টটায় বড়জোর ৩৫% ওদের নিজেদের কার্গো যাবে – ৬৫% দরকার ইন্ডিয়া থেকে কার্গো।"
"একইভাবে আরও বহু যে সব প্রকল্পের কথা ওনারা ভাবছেন অন ইকোনমিক ফ্রন্ট আর কানেক্টিভিটি – সেগুলোতেও ইন্ডিয়াকে খুব ভালভাবে দরকার।"
"ওনারা যদি এটা উপলব্ধি করেন এবং সেই অনুযায়ী এনগেজ করেন, তাহলে রিলেশনশিপ আবার 'কামব্যাক' করতেই পা", জানাচ্ছেন প্রবীর দে।
ফলে এই মুহুর্তে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে শৈত্য বা 'ফ্রিজ' চলছে – সেটা সাময়িক – আগামী দিনে কেটে যেতে বাধ্য, এমনটাও দিল্লিতে অনেকেরই বিশ্বাস।
আর তার কারণটাও খুব সহজ, শেষ পর্যন্ত দু'জনেরই দুজনকে খুব বেশি করে দরকার।
গত বছরের ৫ই অগাস্ট বাংলাদেশে ক্ষমতার নাটকীয় পটপরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে ধরনের আমূল পরিবর্তন এসেছে তা এক কথায় অভাবিত। বহুদিনের মিত্র দুটো দেশের সরকার এখন দৃশ্যতই পরস্পরকে সন্দেহ ও অবিশ্বাস করছে, ঠিক শত্রুতা না হলেও সম্পর্ক গড়াচ্ছে বিদ্বেষের দিকে।
বাংলাদেশের পথেপ্রান্তরে 'দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা' স্লোগানের ধ্বনি আর পাশাপাশি ভারত জুড়ে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা কিংবা কথিত বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান – দুটো দেশের মাঝে আচমকাই যেন অনতিক্রম্য একটা দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে।
যে বাংলাদেশকে ভারত তাদের 'প্রতিবেশ' বা নেইবারহুডে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে দাবি করতো – সে দেশে এখন ভারতের ভিসা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ, বাংলাদেশকে দেওয়া বিভিন্ন বাণিজ্য সুবিধাও একের পর এক বাতিল, সে দেশে অবকাঠামো, জ্বালানি-সহ বিভিন্ন খাতে ভারতের বহু প্রকল্পের কাজও অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি হয়ে আছে।
দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, বিডিআর ও বিএসএফের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষ পর্যন্ত ঘটছে হামেশাই – কখনো আবার তাতে যোগ দিচ্ছেন দু'দিকের স্থানীয় গ্রামবাসীরাও।
দু'দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানও একরকম স্তব্ধ, এমন কি পর্যটন বা চিকিৎসা সফরও এখন সাধারণের নাগালের বাইরে।
বস্তুত ভারত এটাও পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তারা ন্যূনতম প্রয়োজনের বাইরে পুরোদস্তুর কোনও 'এনগেজমেন্টে' যেতেও আগ্রহী নয় – যে কারণে গঙ্গা চুক্তির নবায়ন কিংবা অভিন্ন নদীগুলোর জল ভাগাভাগির মতো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও থমকে আছে।
বস্তুত দু'দেশেই পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা এটা মানেন, বাংলাদেশে অন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত এক বছরে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ঠিক বন্ধুত্বপূর্ণ বা স্বাভাবিক বলা চলে না কোনও মতেই।
'ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ' বা কাজ চালানোর মতো সম্পর্কটা হয়তো কোনওক্রমে টিঁকে আছে, কিন্তু পারস্পরিক আস্থা বা ভরসার জায়গাটা যে হারিয়ে গেছে এটা বোঝার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হওয়ারও কোনো দরকার নেই।
আর সম্পর্কের এই অবনতির ক্ষেত্রে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক - সব ধরনের মাত্রা বা 'ডায়মেনশন'ই কিন্তু আছে।
দিল্লির দিক থেকে এই ফ্যাক্টরগুলো ঠিক কীভাবে কাজ করেছে – অথবা ঠিক কোন কোন দৃষ্টিকোণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে, এই প্রতিবেদনে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে সেটাই।
'সম্পর্কটা ছিল একজন মাত্র ব্যক্তির সঙ্গে'
যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মাত্র এক বছর আগেও দুই দেশের সরকার 'সোনালি অধ্যায়' বলে বর্ণনা করত, সেটা এত দ্রুত কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়লো, দিল্লিতে এখনও কান পাতলেই তার নানা ব্যাখ্যা শোনা যায়।
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটা হল, আসলে ভারতের এই তথাকথিত সুসম্পর্কটা ছিল একজন ব্যক্তি বা একটি দলের সঙ্গে – পুরো দেশটার সঙ্গে নয়।
দিল্লিতে পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ তথা ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তর বলতে কোনও দ্বিধা নেই, শুধু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রিজম দিয়ে বাংলাদেশকে দেখেছিল ভারত – আর তার জন্যই দিল্লিকে আজ চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
তার কথায়, "ভারতের একটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল আওয়ামী লীগের সাথে – এবং শেখ হাসিনার সাথে অফ কোর্স। তারপরে উনি যখন ২০০৯ জানুয়ারিতে ইলেক্টেড হয়ে আসলেন, সেই যে কাজটা শুরু করেছিলেন ভারতের সাথে সেটা ও দেশের কোনও গভর্নমেন্টই এর আগে করতে পারেনি।"
তিনি আরো জানাচ্ছেন, শেখ হাসিনা শুধু ভারতের 'সিকিওরিটি কনসার্ন'গুলোই অ্যাড্রেস করেননি, ভারত যেভাবে ট্রেড বা কানেক্টিভিটি প্রোজেক্টগুলো চেয়েছিল সেটাও তার মতো করে আগে কোনও সরকার করেনি।
কিন্তু এই সুবিধা পেতে গিয়ে ভারত বাংলাদেশের ভেতরে কী অন্তর্দ্বন্দ্ব (ক্রস কারেন্টস) তৈরি হচ্ছে কিংবা শেখ হাসিনার কার্যকলাপ নিয়ে জনরোষ সৃষ্টি হচ্ছে কি না, সে দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।
"মানে একদম একজনের সাথেই শুধু কাজ করছি, কিন্তু সে কী করছে সেটাকে ইন্টারনাল ম্যাটার বলে ইগনোর করে যাচ্ছি – আমরা শুধু দেখছি আমাদের সাথে তো সম্পর্ক ভাল আছে, বাকিটা আমাদের কিছু যায় আসে না।"
"কিন্তু এই পুরো জিনিসটার একটা ড্রাস্টিক ট্রান্সফর্মেশন হলো ফিফথ অগাস্টে। আর ঠিক তার আগে এটাও আমরা দেখেছি একটা চরম বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে – আর তাদের স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে ভারতের বিরুদ্ধেও", বিবিসিকে বলছিলেন শ্রীরাধা দত্ত।
এরপর যখন সেই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভারতেই আশ্রয় ও আতিথেয়তা পেলেন, ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভটা তাতে আরও বাড়লো।
সেই জায়গা থেকেই বাংলাদেশে যে 'একটা অদ্ভুত রাগ' ভারতের ওপর তৈরি হয়েছিল – আজকের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ঠিক সেটারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই বিশেষজ্ঞ।
এত বিনিয়োগ, এত স্টেক – তবুও কেন অস্বস্তি?
কিন্তু যে বাংলাদেশে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ জড়িয়ে – এবং সেখানে বিভিন্ন সেক্টরে ভারতের যে বিপুল বিনিয়োগ – সেখানে তো অন্তত এইসব সামরিক বা অর্থনৈতিক কারণেও দিল্লির তরফে একটা মসৃণ সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত ছিল?
ভারতের অর্থনীতিবিদ ও আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি-র বিশেষজ্ঞ ড: প্রবীর দে মনে করেন, ভারত যে বাংলাদেশে তাদের এই 'ইন্টারেস্ট'গুলো খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে তা নয় – তবে গোটা বিষয়টাকে একটা 'পজ' বা সাময়িক বিরতির মোডে রাখা হয়েছে।
দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আরআইএস-এর এই অধ্যাপক বিবিসিকে বলছিলেন, "না, সম্পর্কটা বিগড়ে যায়নি। আমি সেটা বলবো না। সম্পর্কটা আছে ... কিন্তু ব্যাপারটা এরকম যে দুটো বন্ধুর মধ্যে এখন কিছুদিন কথাবার্তা হচ্ছে না।"
"অন্যভাবে বললে, সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু আমরা ঠিক করেছি যে এখন কিছুদিন অন্যভাবে থাকা যাক। আমরা এখন ওয়েট করে আছি, বিশেষ করে ইন্ডিয়ার দিক থেকে, যে বাংলাদেশ কখন 'ফার্স্ট মুভ'টা করবে।"
তিনি আরো জানাচ্ছেন. এই 'ফার্স্ট মুভ' – বা সম্পর্কটা আবার স্বাভাবিক করতে কোনও এক পক্ষের দিক থেকে ইঙ্গিত - সেটা বোধহয় বাংলাদেশে নির্বাচনের স্পষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা হলে বা একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পরই হবে বলে ভারতের ধারণা।
"আসলে বাংলাদেশ ও ভারত দুজনে দুজনকে নিয়েই থাকতে চায় – সেটাই স্বাভাবিক, কারণ নেইবার আমরা। প্রতিবেশীকে তো আর পাল্টানো যায় না।"
"কিন্তু এবারে যেটা হয়েছে যে একটা অদ্ভুত দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে ... দুটো দেশের মধ্যে যে রিলেশনটা একাত্তর বা তারও আগে থেকে তৈরি হয়েছিল, যেটা সরকার পরিবর্তন হলেও ভেঙে যায়নি – এবারে সেখানে আঘাতটা লাগানো হচ্ছে। কুড়ালটা ওখানে মারা হয়েছে আর কী।", বলছিলেন প্রবীর দে।
তার কথায় স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যেভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে এবং বিভিন্ন কৌশলগত বা সামরিক ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার পথে এগোচ্ছে ভারতের পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে কয়েকটা 'রেড লাইন' আছে পাকিস্তান অবশ্যই তার একটা – আর সেই অস্বস্তিকর সীমানাটা অতিক্রম করা হয়েছে বলেই ঢাকার সঙ্গে এই মুহুর্তে দিল্লির সহজ সম্পর্ক সম্ভব নয়, এমনটাও মনে করছেন দিল্লিতে অনেক বিশ্লেষক।
ছায়া ফেলছে রাজনৈতিক যে কারণ
সম্পর্কের অবনতির ক্ষেত্রে ভারতের শাসক দল বিজেপি আবার যে রাজনৈতিক ব্যাখ্যাটা দিচ্ছে তা হল – বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতীয় মিডিয়ার খবরকে যতই ফেক নিউজ বা অতিরঞ্জন বলে উড়িয়ে দিন – সেখানে হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অজস্র অভিযোগ গত এক বছরে ভারতে যে পরিমাণ গুরুত্ব পেয়েছে এবং ভারত সরকার এই ইস্যুতে নিয়মিত যেভাবে কঠোর বিবৃতি দিয়েছে – সেটা তার আগে সাম্প্রতিককালে কখনোই দেখা যায়নি।
ভারতে অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন, পাশের মুসলিম-প্রধান দেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের এই সব ঘটনাকে ভারতের ক্ষমতাসীন দল খুব সুকৌশলে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে – এবং সেখানে সম্পর্কটা এখন স্বাভাবিক করার তাগিদ অন্তত ভারতের দিক থেকে থাকার কথা নয়।
তার ওপর আর মাত্র আট-দশ মাসের মধ্যে (২০২৬ মার্চ-এপ্রিল) পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন, যে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য বিজেপি বহুদিন ধরেই মরিয়া।
ভারতের অভ্যন্তরে আসন্ন এই নির্বাচনের বাস্তবতাও সম্ভবত ভারতের শাসক দলের বৈদেশিক নীতিকে প্রভাবিত করছে।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির নতুন প্রেসিডেন্ট তথা দলের পার্লামেন্টারিয়ান শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য কোনও রাখঢাক না করেই বলছেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দুর্দশার বিষয়টি ভারতের পক্ষে কিছুতেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয় – তাই তারা বিষয়টি নিয়ে সরব হচ্ছেন।
বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, "যে ঘটনা বাংলাদেশে ঘটছে, তাতে একজন পশ্চিমবঙ্গ-বাসী হিসেবে – বা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের এপার বাংলা-ওপার বাংলার যে সম্পর্ক – তা থেকে একটা অদ্ভুত মানসিকতা মনে হচ্ছিল, যে এটা পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থায় আবার ফিরে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে।"
"এবং এই অত্যাচারটা বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে আজকে থেকে চলছে না – অত্যাচারটা কিন্তু শেখ হাসিনার সময়েও হয়েছে", জানাচ্ছেন তিনি।
এখানে বাংলাদেশ সরকারের বা সে দেশের সিভিল সোসাইটির অবস্থানকেও একটা 'ডিনায়াল মোড' বলে বর্ণনা করছেন তিনি।
"ঢাকা শহরে কিছু মানুষ আছেন যারা বলেন 'আমরা খুব ভালো আসি, আমাদের কোনো অসুবিধা নাই – না না এই সমস্ত গুজব' ... কিন্তু গ্রামগঞ্জে যে অত্যাচার হচ্ছে সেটার খবর তো আমরা পাচ্ছি", বলছিলেন শমীক ভট্টাচার্য।
"আর একটা হচ্ছে, এই যে বিনা যুদ্ধে ভারত দখলের একটা চক্রান্ত চলেছে দীর্ঘদিন ধরে – যে 'চিকেন নেকে'র ওখানে ... ওটাকে কেটে নাও ... তো এই বিষয়গুলো আমাদের তো একটু চিন্তাভাবনার মধ্যে রাখা উচিত।"
ফলে সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে বাকি ভারতের সংযোগের সূত্র যে শিলিগুড়ির কাছে সরু করিডর, তার 'ভালনারেবিলিটি' নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্যও যে ভারত ভালভাবে নিচ্ছে না – সেই আভাসও ছিল পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতির গলায়।
সম্পর্ক কি আবার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব?
দিল্লিতে অনেকে আবার বিশ্বাস করেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখান থেকেও আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে – যদি আবার দুই দেশ অপরের বিশেষ প্রয়োজনটাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়।
যেমন ভারতের বেশি দরকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, বাংলাদেশের চাই জল।
উভয় দেশ যদি পরস্পরের এই অগ্রাধিকারটা উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে সম্পর্কে অগ্রগতি হওয়া সম্ভব বলেই অনেকে মনে করছেন।
পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তর কথায়, "আমরা (বাংলাদেশের) সব জায়গাতেই দেখি, সোশ্যাল মিডিয়াতে বা অন্য কোথাও – অসম্ভব একটা অ্যান্টি-ইন্ডিয়া রেটোরিক চলে।"
"এটা তো নিশ্চই সেখানে ইয়ুথরাই করে, কারণ ওদের একটা খুব বিতৃষ্ণা দাঁড়িয়ে গেছে, অ্যাবাউট ইন্ডিয়া। তো সেই জায়গাটা আমাদের পক্ষে বোধহয় একদম নর্মাল করা ... কঠিন, কিন্তু বোধহয় অসম্ভব নয়।"
তার যুক্তি হলো, বাংলাদেশের কাছে যেহেতু সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যু জল – সেখানে নদীর সম্পদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারলেই সম্পর্কে ম্যাজিক ঘটানো সম্ভব।
"যেমন ধরুন তাদের কিছু কিছু কনসার্ন আছে, আমি যেটা বিশ্বাস করি – যেমন ওয়াটার। ওটাতে কেন ইন্ডিয়া প্রোগ্রেস করেনি, কেন ওটা নিয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি?"
"সেই জায়গাগুলো যদি একটু দেখা যেত – তাহলে আমার মনে হয় ওদের কাছেও কিছু ইতিবাচক বার্তা পাঠাতে পারতাম।"
"এটা তো সত্যি, আমাদের সিকিওরিটি আমাদের কাছে প্রায়োরিটি, কিন্তু ওদের কাছে তো পানির ভাগাভাগি বা ওয়াটার শেয়ারিং-টা প্রায়োরিটি। সেটাতে আমরা একদমই কিছু করিনি।"
"আর যখন চায়না একটা প্রোপোজাল দিল তিস্তার ম্যানেজমেন্টের, তাতে রেগে গিয়ে বললাম না না ওটা আমরা করবো। কিন্তু আমরা কি এগিয়েছিলাম? তাও তো করিনি, না", বেশ হতাশার সুরেই বলেন শ্রীরাধা দত্ত।
অর্থনৈতিক স্বার্থই কি রূপোলি রেখা?
এই জটিল বিতর্কে আর একটা মতবাদ হলো, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং বাণিজ্যিক বাস্তবতাই দুই প্রতিবেশীকে আবার কাছাকাছি আনতে পারে – যেটা অন্য আর কোনও ফ্যাক্টর সেভাবে পারবে না।
আগামী বছর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হচ্ছে – কিন্তু এই 'প্রোমোশনে'র সঙ্গে সঙ্গেই কোটা-সহ বেশ কিছু পুরনো বাণিজ্য সুবিধা বাতিল হতে যাচ্ছে, অবধারিতভাবে আসতে চলেছে নতুন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ।
ভারতে কোনও কোনও বিশেষজ্ঞর বক্তব্য, এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দরকার ভারতকে।
অর্থনীতিবিদ প্রবীর দে-র কথায়, "সামনের বছর, মানে ২০২৬-এ বাংলাদেশ এলিভেট করছে ডেভেলপিং কান্ট্রি হিসেবে। এখন সেই 'থ্রাস্ট' ওদের দরকার একটা ... সেই থ্রাস্টটা পেতে গেলে ... মানে একটা ফ্লাইটকে, প্লেনকে টেক-অফের সময় ওপরে উঠতে গেলে যেমন একটা থ্রাস্ট দরকার, এখানেও ঠিক তাই।"
"নেক্সট ইয়ারে ডেভেলপিং কান্ট্রিতে ওনারা এলিভেট করার পর সেখান থেকে যদি তারপরে ফ্লাই করতে হয়, মানে লং টাইম অ্যাজ আ ডেভেলপিং ইকোনমি – তাহলে বাংলাদেশের দরকার ইন্ডিয়াকে, ভারতবর্ষকে।"
"তো এছাড়া কে ওনাদের হেল্প করতে পারবে? অন্য কোনো কান্ট্রি তো সেভাবে পারবে না।"
ভারতের এই সম্ভাব্য সহযোগিতার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তিনি টেনে আনছেন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের কথা।
"ধরুন, ওনারা যে পোর্টটা তৈরি করছেন মাতারবাড়িতে, একটা বড় ডিপ সি পোর্ট ... সেই পোর্টটায় বড়জোর ৩৫% ওদের নিজেদের কার্গো যাবে – ৬৫% দরকার ইন্ডিয়া থেকে কার্গো।"
"একইভাবে আরও বহু যে সব প্রকল্পের কথা ওনারা ভাবছেন অন ইকোনমিক ফ্রন্ট আর কানেক্টিভিটি – সেগুলোতেও ইন্ডিয়াকে খুব ভালভাবে দরকার।"
"ওনারা যদি এটা উপলব্ধি করেন এবং সেই অনুযায়ী এনগেজ করেন, তাহলে রিলেশনশিপ আবার 'কামব্যাক' করতেই পা", জানাচ্ছেন প্রবীর দে।
ফলে এই মুহুর্তে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে শৈত্য বা 'ফ্রিজ' চলছে – সেটা সাময়িক – আগামী দিনে কেটে যেতে বাধ্য, এমনটাও দিল্লিতে অনেকেরই বিশ্বাস।
আর তার কারণটাও খুব সহজ, শেষ পর্যন্ত দু'জনেরই দুজনকে খুব বেশি করে দরকার।
‘আমরা অপেক্ষা করব ভারত বাঁধ তৈরি করুক, আর তৈরি করলেই দশটি মিসাইল দিয়ে ধ্বংস করব। ইন্দুস নদী ভারতীয়দের পারিবারিক সম্পত্তি নয়… আমাদের মিসাইলের কোনো অভাব নেই, আলহামদুলিল্লাহ।’
১৩ ঘণ্টা আগেমধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা বন্ধ করে গাজায় চলমান সংকট ও দুর্ভোগ দূর করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো দুই রাষ্ট্রের সমাধান, যা মানবতার জন্য একমাত্র আশার আলো।
১৪ ঘণ্টা আগে