ইতিহাস
সিন্ধুর পানিবণ্টন চুক্তির ইতিহাস

পানি জীবন এবং নদী তার অন্যতম প্রধান উৎস। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে বিশাল নদী ব্যবস্থা আছে, তার মূল শিরা হলো সিন্ধু নদী ও এর শাখানদীগুলো। এই নদীগুলি কোটি কোটি মানুষের জীবন, কৃষি ও অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে যখন ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান জন্ম নেয়, তখন এই নদীগুলির পানিবণ্টন নিয়ে বড় এক সমস্যা তৈরি হয়। কারণ, সিন্ধু নদী ও তার পাঁচটি প্রধান শাখা — ঝেলম, চেনাব, রবি, বিয়াস ও শতদ্রু — ভারতের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে। ফলে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান তার পানি সরবরাহের জন্য একরকমভাবে ভারতের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল ভারত পাকিস্তানের পানিপ্রবাহ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানে তখন ভয়াবহ সেচসংকট দেখা দেয় এবং কৃষি কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সেই সময় পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল যে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্বব্যাংক উদ্যোগ নেয়। তারা দুই দেশের মধ্যে একটি স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে মধ্যস্থতা শুরু করে। প্রায় আট বছরের আলোচনার পর ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান করাচিতে একটি ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিই ‘সিন্ধু নদী পানিবণ্টন চুক্তি’ নামে পরিচিত।
চুক্তির মূল বক্তব্য ছিল, সিন্ধু নদী ব্যবস্থার ছয়টি বড় নদীকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়া হবে। পশ্চিমের তিনটি নদী — সিন্ধু, ঝেলম ও চেনাব — পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয়, আর পূর্বের তিনটি নদী — রবি, বিয়াস ও শতদ্রু — ভারতের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। এর মানে, ভারত পশ্চিম নদীগুলির পানি পুরোপুরি আটকে দিতে পারবে না, তবে সীমিত পরিমাণে সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতে পারবে। আবার পাকিস্তানও পূর্ব নদীগুলির বিষয়ে কোনো দাবি করতে পারবে না। দুই দেশের মধ্যে পানিবণ্টন এবং সমস্যা মেটানোর জন্য একটি স্থায়ী সংস্থা তৈরি করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘পার্মানেন্ট ইন্ডাস কমিশন’। এই কমিশনের প্রতিনিধিরা প্রতিবছর সাক্ষাৎ করেন এবং যদি কোনো সমস্যা হয়, আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করার চেষ্টা করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চুক্তি ছিল দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের জীবনদায়ী সেতু। ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালের যুদ্ধসহ বহু সংঘাতের সময়ও এই চুক্তি বহাল ছিল। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. শিবশঙ্কর মেনন বলেন, সিন্ধু চুক্তি আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনীতির একটি বিরল সাফল্য, যেখানে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ নিজেদের যৌথ স্বার্থে একত্র হয়েছে। পাকিস্তানের পানি বিশেষজ্ঞ ড. পারভেজ আমিরের মতে, এই চুক্তি পাকিস্তানের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে। তার ভাষায়, ভারতের সঙ্গে যতই রাজনৈতিক সমস্যা থাকুক না কেন, পানির প্রবাহ নিশ্চিত না হলে পাকিস্তানের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ত।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু সমস্যা ও বিতর্কও তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ভারত যখন তার অংশের নদীগুলিতে নতুন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করেছে, তখন পাকিস্তান আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে এতে তাদের পানিপ্রাপ্তি কমে যাবে। কাশ্মীর অঞ্চলে কিষানগঙ্গা প্রকল্প কিংবা বাগলিহার বাঁধ নিয়ে পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকের কাছে অভিযোগও করেছে। যদিও ভারত প্রতিবার বলেছে, তারা চুক্তির শর্তের মধ্যেই সব কাজ করছে, তবুও পাকিস্তানের মধ্যে সংশয় থেকেই গেছে। তবে, কাশ্মিরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত এই চুক্তিটি বাতিল করেছে।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো জলবায়ু পরিবর্তন। পরিবেশবিদ ড. রাহুল রামেশের মতে, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সিন্ধু নদীতে পানিপ্রবাহ কমে আসছে, যার ফলে ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে পানির জন্য টানাপোড়েন আরও বাড়তে পারে। তার মতে, এখনই দুই দেশের উচিত হবে একসঙ্গে বসে নতুন করে সহযোগিতার পথ খুঁজে বের করা, নইলে ভবিষ্যতে ছোটখাটো বিবাদ বড় আকার নিতে পারে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই চুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে দুই দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। চুক্তির ধারা অনুযায়ী, কোনো দেশ একতরফাভাবে এটিকে বাতিল করতে পারে না। তবে যদি রাজনৈতিক চাপ বাড়ে এবং উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়, তাহলে পানির বিষয়টি নতুন করে উত্তপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে ভারতের কিছু রাজনৈতিক মহল মাঝে মাঝে দাবি করে থাকে, যদি পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে মদদ দেয়, তবে সিন্ধু চুক্তির পুনর্বিবেচনা করা উচিত। এতদিনে ভারত সেই পদক্ষেপ নিল।
এদিকে পাকিস্তানও আন্তর্জাতিক মহলে সিন্ধু চুক্তিকে নিজের অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে তুলে ধরে। তারা বহুবার বলেছে, ভারতের কোনো একতরফা পদক্ষেপ বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ফলে দেখা যাচ্ছে, চুক্তিটি দুই দেশকেই এক ধরনের পারস্পরিক নির্ভরতার বন্ধনে বেঁধে রেখেছে।
সিন্ধু নদী শুধুই একটি নদী নয়, এটি এক প্রকার প্রাণরসধারা। ১৯৬০ সালে যখন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তখন হয়তো কেউই ভাবতে পারেনি যে এটি এত দীর্ঘ সময় টিকে থাকবে। অথচ, এখন পর্যন্ত নানা ঝড়ঝাপ্টার মাঝেও এই চুক্তি কার্যকর রয়েছে। এটা প্রমাণ করে, যেখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং বাস্তব প্রয়োজন মিলে যায়, সেখানে শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হয়।
ভবিষ্যতের জন্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, দুই দেশের উচিত হবে সিন্ধু চুক্তিকে আরও আধুনিক করা। বর্তমান সময়ের চাহিদা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন — সবকিছুকে মাথায় রেখে নতুন করে আলোচনায় বসা প্রয়োজন। পানি কোনো দেশের একার সম্পদ নয়; এটি একটি শেয়ার করা জীবনীশক্তি। ভারত ও পাকিস্তান যদি আগামী দিনে নদীগুলোকে বিভাজনের প্রতীক না বানিয়ে সহযোগিতার সেতুতে পরিণত করতে পারে, তাহলে সেটাই হবে সত্যিকারের জয়।
সিন্ধু নদীর প্রবাহ যেমন কোটি কোটি প্রাণকে জীবিত রাখে, তেমনি সিন্ধু চুক্তির প্রবাহও দুই দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আশা বাঁচিয়ে রাখে।
সূত্র: হিস্ট্রি ডট কম