top ad image
top ad image
home iconarrow iconবিশ্ব রাজনীতি

কাশ্মীরে হামলা: হামলাকারীদের খোঁজে উপত্যকাজুড়ে অভিযান

কাশ্মীরে হামলা: হামলাকারীদের খোঁজে উপত্যকাজুড়ে অভিযান
পহেলগামের নিরাপত্তা বাহিনীর টহল চলছে

জম্মু এবং কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিদের হত্যালীলার পর গোটা দেশে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। প্রত্যাঘাতের দাবি উঠছে দেশের সর্বত্র। বুধবার সকাল থেকে দফায় দফায় বৈঠক চলেছে নয়াদিল্লিতে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কাশ্মীর উপত্যকার বাস্তব চিত্র দেখে এসেছেন। শেষে সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা বৈঠকের পর ‘প্রত্যাঘাত’ করল ভারত।

পাকিস্তানিদের ‘সার্ক’ ভিসা বাতিল, সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করাসহ ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ পদক্ষেপ করেছে নয়াদিল্লি। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়া বন্ধ না করা পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। তবে হামলায় জড়িত জঙ্গিদের এখনও সন্ধান মেলেনি। তাঁদের খোঁজে গোটা কাশ্মীর উপত্যকাজুড়ে অভিযান চালাচ্ছে বাহিনী।

সকাল থেকে দফায় দফায় বৈঠক

কাশ্মীর উপত্যকায় নৃশংসতার খবর পেয়েই সৌদি আরব সফরে কাঁটছাঁট করে ভারতে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বুধবার সকালেই নয়াদিল্লিতে পৌঁছে যান তিনি। তার পর থেকে শুরু হয় দফায় দফায় বৈঠক। দেশে ফেরার পরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। ওই বৈঠকে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও। তাঁদের থেকে পরিস্থিতির খোঁজখবর নেন মোদি।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহও আলাদা করে দোভালের সঙ্গে একটি বৈঠক সেরে নিয়েছেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বায়ুসেনার এয়ার চিফ মার্শাল এপি সিংহ এবং অন্য আধিকারিকেরা। সূত্রের খবর, কাশ্মীর উপত্যকায় নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ওই বৈঠকে। সন্ধ্যায় ফের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক শুরু হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা ওই বৈঠকে ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ, বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-সহ অন্য শীর্ষ আধিকারিকেরা। শাহ সোমবার ছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরে। সেখানে বাস্তব পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখে বিকেলে ফেরেন নয়াদিল্লিতে। জঙ্গিদের হত্যালীলার পরে ভারতের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয় ওই বৈঠকে।

পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তি অবিলম্বে স্থগিত করে দেওয়া হয়। ওয়াঘা-আটারি সীমান্তে ভারতের ‘ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট’ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যাঁরা বৈধ নথিতে এ দেশে এসেছেন, তাঁদের ১ মে’র মধ্যে একই পথে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে ‘সার্ক’ ভিসা। যে পাকিস্তানিরা ‘সার্ক’ ভিসায় ভারতে রয়েছেন, তাঁদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে বলা হয়েছে। নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানি দূতাবাসে থাকা প্রতিরক্ষা আধিকারিকদের ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছে মোদি সরকার। তাঁদের এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়েছে।

একই রকম ভাবে ভারতও ইসলামাবাদে থাকা দূতাবাস থেকে প্রতিরক্ষা আধিকারিকদের দেশে ফিরিয়ে নেবে। ইসলামাবাদে ভারতীয় দূতাবাসে কর্মীসংখ্যা ৫৫ থেকে ৩০-এ নামিয়ে আনছে নয়াদিল্লি। ভারতে থাকা পাকিস্তানি দূতাবাসের ক্ষেত্রেও ১ মে থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে বলে জানিয়েছে ভারত সরকার। দেশের নিরাপত্তাবিষয়ক সর্বোচ্চ কমিটি- ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিওরিটি (সিসিএস) বুধবার বৈঠকে বসে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে হওয়া ওই বৈঠকেই এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে।

নিহতদের দেহ ফিরল বাংলায়

কাশ্মীরের জঙ্গিহানায় নিহত ২৬ জনের মধ্যে তিন বাঙালিও রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দু’জনের বাড়ি কলকাতায়, অপর জনের পুরুলিয়ায়। বুধবার রাত ৮টা নাগাদ নিহত কলকাতার দুই বাসিন্দার কফিনবন্দি দেহ এসে পৌঁছোয় দমদম বিমানবন্দরে। বেহালার সখেরবাজারের বাসিন্দা সমীর গুহ এবং বৈষ্ণবঘাটা পাটুলির বাসিন্দা বিতান অধিকারীর দেহ বিমানবন্দর থেকে শববাহী শকটে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের বাড়ির উদ্দেশে। পুরুলিয়ার ঝালদার মণীশরঞ্জন মিশ্রের দেহ রাঁচী বিমানবন্দরে আসার কথা। ভারতীয় সেনার নজরদারি থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে পহেলগাঁওয়ে হামলার ঘটনা ঘটে গেল? তা নিয়ে বুধবার উদ্বেগ প্রকাশ করেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি ভেবে পাচ্ছি না, এত ক্ষণ ধরে বেছে বেছে মারল! যেগুলো আমরা শুনতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি... ওখানে তো অনেক আর্মি (সেনা) ছিল। এমনিতে তো সীমান্ত এলাকা। স্পর্শকাতর এলাকা। যাই হোক, এ সব নিয়ে এখন কথা বলব না।’’

জঙ্গিদের খোঁজে কাশ্মীরজুড়ে তল্লাশি

পহেলগাঁওয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত চার জঙ্গিকে শনাক্ত করেছে ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। ইতিমধ্যে চার জনের ছবিও প্রকাশ করে পরিচয় জানানো হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, চার জঙ্গি হল— আদিল, আসিফ ফুজি, সুলেমান শাহ এবং আবু তালহা! গোয়েন্দা সূত্রে দাবি, হামলাকারীরা সংখ্যায় ছিল পাঁচ-ছয় জন। সকলের মুখে ছিল মাস্ক। হাতে একে ৪৭-এর মতো বন্দুক। তাঁদের মধ্যে চার-পাঁচ জন পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আর দু’জন উপত্যকার বাসিন্দা বলে অনুমান গোয়েন্দাদের। সংবাদমাধ্যমের একাংশের দাবি, জঙ্গিদের খুঁজে বার করতে কাশ্মীর জুড়ে ধরপাকড় শুরু হয়েছে।

সংবাদমাধ্যম এবিপি নিউজ-এর একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত কোনও জঙ্গি ধরা পড়ার তথ্য মেলেনি। পহেলগাঁওয়ের হত্যালীলায় জড়িত জঙ্গিদের খোঁজ পেতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে জম্মু এবং কাশ্মীর পুলিশ। কাশ্মীরের অনন্তনাগ পুলিশ বিভাগ জানিয়েছে, জঙ্গিনিধন অভিযানে সাহায্য হওয়ার মতো কোনও তথ্য দিয়ে কেউ সহায়তা করলে তাঁকে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।

উপত্যকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ

মঙ্গলবার সৌদি থেকেই ফোনে অমিত শাহের সঙ্গে কথা বলেন মোদি। শাহকে দ্রুত কাশ্মীরে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। মোদির ফোন পাওয়ার পরই কাশ্মীরের উদ্দেশে রওনা দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সোমবার সারা দিন কাশ্মীর উপত্যকার বাস্তব চিত্র খতিয়ে দেখেন শাহ। বুধবার সকালে তিনি পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় নিহতদের শেষ শ্রদ্ধাও জানান। কথা বলেন তাঁদের পরিজনদের সঙ্গে। কাশ্মীর উপত্যকায় গিয়ে তিনি ভরসা দিয়েছেন, এই নৃশংস জঙ্গি হামলায় দোষীরা কেউ রেহাই পাবে না।

কাশ্মীরে জঙ্গি অনুপ্রবেশ ঘিরে উদ্বেগ

ইতিমধ্যেই এলওসি পেরিয়ে অন্তত ৭৫ জন পাকিস্তানি জঙ্গি অনুপ্রবেশ করে নানা নাশকতামূলক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে ওই গোয়েন্দা রিপোর্ট জানাচ্ছে। এদের মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ জন জম্মু, রাজৌরি এবং পুঞ্চ অঞ্চলে সক্রিয়। মূলত দক্ষিণ কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকা তাদের নিশানায়। এমনই একটি দল মঙ্গলবার অনন্তনাগ জেলার পহেলগাঁওয়ে হামলা চালিয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। স্থানীয় দুই জঙ্গির সহায়তায় ২৬ জনকে খুন করেছে তারা। বুধবার একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট উদ্ধৃত করে প্রকাশিত কয়েকটি খবর জানিয়েছে, এই মুহূর্তে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ৪২টি ‘লঞ্চ প্যাডে’ অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে অন্তত ১১৫ জন জঙ্গি।

সন্ত্রাসবাদে অতিষ্ঠ কাশ্মীরের আমজনতা

কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদের প্রতিবাদে বুধবার রাস্তায় নামলেন জম্মু এবং কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। মঙ্গলবার রাত থেকে পহেলগাঁওয়ের রাস্তায় প্রতিবাদে নেমেছেন বহু স্থানীয় মানুষ। মোমবাতি নিয়ে মিছিল করছেন তাঁরা। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, নিরীহদের হত্যার বিরুদ্ধে সেই মিছিল থেকে উঠছে স্লোগান। কাশ্মীরিরা বলছেন, ‘হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’, ‘আমরা ভারতীয়’। এখনও পহেলগাঁওয়ে যে সমস্ত পর্যটক আটকে আছেন, তাঁদের আগলে রেখেছেন স্থানীয়েরাই। জঙ্গি হামলার প্রতিবাদে এবং নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পহেলগাঁওয়ের ব্যবসায়ীরা বুধবার দিনভর দোকানপাট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সম্পূর্ণ ‘শাট ডাউনের’ ডাক দেওয়া হয়েছে স্থানীয় মসজিদগুলি থেকে। প্রায় সকলেই সেই ডাকে সাড়া দিয়েছেন।

অনেকের মতে, গত ৩৫ বছরে কাশ্মীরে এই চিত্র দেখা যায়নি। পহেলগাঁওয়ের দোকানি এবং হোটেল ব্যবসায়ীরা বুধবার সকালেও একটি মিছিলে হেঁটেছেন। হোটেল মালিকেরা জানিয়েছেন, আটকে থাকা পর্যটকদের সব রকম সাহায্য করা হবে। সূত্র : আনন্দবাজার

r1 ad
top ad image