ইতিহাস
লেপান্টোর যুদ্ধ: ভূমধ্যসাগর দখলের রক্তাক্ত ইতিহাস

সময়টা ১৫৭১ সাল। ভূমধ্যসাগরের উপর তখন উসমানীয় সাম্রাজ্যের ছায়া। চারদিকে তাদের দাপট—জল, স্থল, কোথাওই কেউ তাদের মুখোমুখি হতে সাহস করে না। ইউরোপীয় শক্তিগুলো তখন ভীত আর বিভক্ত। কিন্তু ঠিক সেই সময়, ভূমধ্যসাগরের একটি ছোট্ট উপসাগরে ঘটেছিল এমন এক যুদ্ধ, যা ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে সবচেয়ে ভয়াবহ নৌযুদ্ধগুলোর একটি হিসেবে—লেপান্টোর যুদ্ধ।
এই যুদ্ধ শুধু দুই পক্ষের বাহুবলের লড়াই ছিল না, ছিল রাজনীতি, ধর্ম আর আধিপত্যের সংঘর্ষ। উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় সেলিম ঠিক করেছিলেন, তিনি ভেনিসের শাসনে থাকা সাইপ্রাস দ্বীপ দখল করবেন। এই দ্বীপ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ—যার দখলে সাইপ্রাস, সে ভূমধ্যসাগরের রাস্তাঘাট ও বাণিজ্য অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
সেলিম যখন বিশাল এক বহর নিয়ে সাইপ্রাস আক্রমণ করলেন, তখন ইউরোপের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে পড়ে। বহু দুর্গ ধ্বংস করে অবশেষে উসমানীয়রা ফামাগুস্তা নামে এক গুরুত্বপূর্ণ শহরও ঘিরে ফেলে। প্রায় এক বছরের অবরোধের পর ১৫৭১ সালের আগস্টে শহরটি পড়ে যায়।
এই অবস্থায় ভেনিস সাহায্যের জন্য ছুটে যায় রোমান ক্যাথলিক গির্জার প্রধান পোপ পঞ্চম পায়াসের কাছে। পোপ বহুদিন ধরেই চেয়েছিলেন ক্যাথলিক রাজ্যগুলোকে একত্র করে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে বড়সড় প্রতিরোধ গড়তে। এবার সেই সুযোগটা তিনি কাজে লাগান।
পোপ ভেনিস, স্পেন, জেনোয়া, মাল্টা এবং আরও কিছু ইতালিয়ান রাজ্যকে একত্র করে গড়েন ‘হলি লীগ’ নামের একটি জোট। এর নেতৃত্বে আসেন স্পেনের রাজার সৎ ভাই, তরুণ সেনানায়ক ডন জন অব অস্ট্রিয়া। এই জোটের উদ্দেশ্য একটাই—উসমানীয় নৌবাহিনীকে রুখে দেওয়া।
জোটের সব জাহাজ জড়ো হয় ইতালির মেসিনা শহরে। অনেকদিন অপেক্ষা করে তারা শেষ পর্যন্ত সাগরে পাড়ি দেয়। তাদের সামনে তখন শক্ত প্রতিপক্ষ—উসমানীয় নৌবাহিনী, নেতৃত্বে আলি পাশা।
হলি লীগ হাতে পেয়েছিল প্রায় ২১১টি বড় গ্যালি ধরনের যুদ্ধজাহাজ, সঙ্গে ছিল আরও কিছু বড় কামান-বাহী জাহাজ। সৈন্য ও নাবিক মিলিয়ে তাদের বাহিনী ছিল প্রায় ৭০ হাজার। কামান ছিল দুই হাজারের কাছাকাছি।
অন্যদিকে আলি পাশার উসমানী বহরে ছিল প্রায় ২৫৫টি জাহাজ, তার মধ্যে ৪৫টি ছিল ছোট আকারের গ্যালিয়ট। মোট সেনা ছিল প্রায় ৮০ হাজার, কিন্তু কামানের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭৫০। এছাড়া, তাদের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব ছিল ইউরোপীয়দের তুলনায় অনেক বেশি।
যুদ্ধ শুরু হয় গ্রীসের লেপান্টোর উপকূলের কাছে। ভোর থেকেই সাগরের বাতাসে উত্তেজনা। একদিকে ডন জন তার বাহিনী সাজিয়ে রেখেছেন চার ভাগে। মাঝখানে নিজে, ডানে স্প্যানিশ অ্যাডমিরাল ডোরিয়া, বামে ভেনেশিয়ান নেতা বারবারিগো, আর রিজার্ভ ফোর্সের নেতৃত্বে আলভারো বাজান।
আলি পাশাও নিজের বাহিনী তিন ভাগে ভাগ করেন। মধ্যভাগে নিজে, ডানে মিশরের গভর্নর শৌলাক, আর বামে আলজিয়ার্সের শাসক উলুখ আলি।
যুদ্ধ শুরু হয় ইউরোপীয় বাহিনীর বাম পাশে। বারবারিগো-এর স্কোয়াড্রনে আঘাত হানে শৌলাকের জাহাজগুলো। ভয়াবহ লড়াই হয় সেখানে। বারবারিগো নিহত হন, অনেক ইউরোপীয় সৈন্য মারা যায়। কিন্তু বাজান দ্রুত রিজার্ভ জাহাজ পাঠিয়ে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেন। শৌলাক মারা যান, তার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই হয় মাঝখানে—ডন জন ও আলি পাশার মাঝে। আলি পাশা নিজের জাহাজ ‘সুলতানা’ নিয়ে সরাসরি ধাক্কা দেন ডন জনের জাহাজ ‘রিয়ালে’-এর গায়ে। দুই জাহাজের মাঝখানে তখন হাতাহাতি, তলোয়ারের লড়াই, কামানের গর্জন—সব মিলিয়ে এক বিভীষিকাময় দৃশ্য।
শেষ পর্যন্ত বাজানের সহায়তায় ডন জনের বাহিনী আলি পাশার বাহিনীকে হারিয়ে দেয়। আলি পাশা নিহত হন, তার পতাকাবাহী জাহাজ দখল করে নেয় ইউরোপীয়রা।
যেখানে একের পর এক ইউরোপীয় বাহিনী জয় পাচ্ছিল, সেখানে উলুখ আলির নেতৃত্বে উসমানীয় বাহিনী ডোরিয়ার বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলে। ডোরিয়া পিছু হটতে বাধ্য হন। উলুখ আলি এই সুযোগে ডন জনের মূল স্কোয়াডের দিকে এগোতে থাকেন। যুদ্ধের ভাগ্য তখন কাঁটার দাঁড়ে।
কিন্তু মাল্টার নাইটদের শক্ত প্রতিরোধ ও বাজানের চূড়ান্ত নেতৃত্বে উলুখ আলিকে বাধ্য হতে হয় পিছু হটতে। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের বেঁচে থাকা জাহাজ নিয়ে নিরাপদে সরে যান।
এই যুদ্ধ ইউরোপীয়দের জন্য ছিল এক ঐতিহাসিক জয়। তারা প্রায় ১০০টি উসমানীয় জাহাজ দখল করে নেয়, ধ্বংস করে ৫০টির বেশি। ইউরোপীয়দের মাত্র ১২টি জাহাজ হারায়।
পোপ এই জয়কে বিশাল এক বিজয় বলে ঘোষণা দেন। ক্যাথলিক রাজারা খুশি হয়ে একে নিজেদের গৌরবের প্রতীক বানান। কিন্তু সামরিক দিক থেকে এই জয় খুব বেশিদিনের জন্য কোনো পরিবর্তন আনেনি।
হলি লীগ নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ও মতবিরোধে জড়িয়ে পড়ে। তারা উসমানীয়দের বিরুদ্ধে পরবর্তী আক্রমণ চালাতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে উসমানীয়রা আবার নিজেদের শক্তি পুনর্গঠন করে নেয়।
পরাজয়ের পরে সুলতান সেলিম এবং তার প্রধানমন্ত্রী মেহমেদ পাশা (যিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক) এই পরাজয়কে তেমন গুরুত্বই দেননি। ভেনিসের দূতের কাছে মেহমেদ পাশা বলেন, “লেপান্টোর পরাজয় আমাদের দাড়ি কামানোর মতো, কিন্তু সাইপ্রাস দখল করে আমরা তোমাদের একটা বাহু কেটে ফেলেছি। দাড়ি আবার গজাবে, কিন্তু বাহু আর গজাবে না।”
এই কথার প্রমাণও মিলেছিল দ্রুত। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই উসমানীয়রা নতুন করে ২৫০টি জাহাজ তৈরি করে, যার মধ্যে আটটি ছিল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় যুদ্ধজাহাজ।
যদিও সামরিকভাবে ইউরোপীয়দের বিজয় স্থায়ী হয়নি, এই যুদ্ধের একটি বড় প্রতীকী গুরুত্ব ছিল। এটি ছিল উসমানীয় নৌবাহিনীর প্রথম বড় পরাজয়। ইউরোপের মানুষদের মনে এই প্রথম ধারণা জন্ম নেয়—তুর্কিদের হারানো সম্ভব।
লেপান্টোর পর ভূমধ্যসাগরের পশ্চিমাংশে ইউরোপীয় আধিপত্য বাড়তে থাকে। উসমানীয়দের অগ্রযাত্রা সম্পূর্ণ থেমে না গেলেও, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার সাহস ও সংগঠনের জন্ম দেয় এই যুদ্ধ।
লেপান্টোর যুদ্ধ ছিল ধর্ম, সাম্রাজ্য আর শক্তির সংঘর্ষের প্রতীক। এখানে রক্ত ঝরেছিল শুধু ভূমধ্যসাগরের দখল নয়, পুরো ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে। ইতিহাসে এই যুদ্ধ শুধু একদিনের রক্তক্ষয়ী ঘটনা নয়—এটি ছিল দুই দুনিয়ার, দুই চিন্তার, দুই সভ্যতার মুখোমুখি সংঘর্ষ, যার প্রতিধ্বনি বহু বছর ধরে ইতিহাসের পাতায় ধ্বনিত হয়ে চলেছে।
সূত্র: হিস্ট্রি ডট কম