ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
শীতল পাহাড়ের বুক চিড়ে যে আগুন একদিন হঠাৎ জ্বলে উঠেছিল, সেটি নিছক দুটি দেশের সীমান্ত দ্বন্দ্ব ছিল না। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে এক গভীর ছাপ ফেলেছিল।
সেই যুদ্ধ ছিল ধোঁয়াশার, অবিশ্বাসের আর আত্মতুষ্টির ফল। আর এই সবকিছুর মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল ভারতের তরুণ রাষ্ট্র এবং চীনের নবগঠিত কমিউনিস্ট শাসনের এক কড়াই ফুটন্ত সম্পর্ক। সেই যুদ্ধ শুধু রাইফেলের গুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, তার ছায়া পড়েছিল কূটনীতি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর সাধারণ মানুষের ভাবনাতেও।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন জওহরলাল নেহরু, স্বাধীন ভারতের রূপকারদের একজন। আর চীনের শীর্ষে ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা মাও সেতুং। দুই নেতার মধ্যে প্রথম দিকে বন্ধুত্বের বাতাবরণ থাকলেও সময়ের সঙ্গে সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরে।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর চীনের সঙ্গে একাধিক শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। ‘হিন্দি চিনি ভাই ভাই’ স্লোগান তখন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই সৌহার্দ্য যে এত তাড়াতাড়ি ভেঙে যাবে, তা কেউ কল্পনাও করেনি।
মুল বিরোধের শেকড় ছিল হিমালয়ের বরফঢাকা সীমান্তে। ভারতের উত্তর-পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ (তৎকালীন নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার অ্যাজেন্সি) এবং উত্তর-পশ্চিমে লাদাখের আকসাই চিন অঞ্চল ছিল এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রস্থল। ব্রিটিশ শাসনামলে গঠিত ম্যাকমাহন রেখা নামের এক কৃত্রিম সীমারেখা চীন কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি।
তাদের দাবি, ওই সীমারেখা অবৈধ এবং তিব্বতের অংশ ভারতের দখলে রয়েছে। অন্যদিকে ভারত বলছিল, এই রেখা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং চীন অহেতুক আগ্রাসন দেখাচ্ছে।
চীনের দিক থেকে আরও এক গভীর ক্ষোভ ছিল তিব্বত প্রসঙ্গ। ১৯৫৯ সালে চীন যখন তিব্বতে দমন-পীড়ন শুরু করে, তখন তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। ভারত সরকার তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়।
এ ঘটনাকে চীন দেখে ভারতীয় হস্তক্ষেপ হিসেবে। চীন বিশ্বাস করত, ভারত চায় তিব্বতের স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে। এই বিশ্বাস থেকেই দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ে।
ভারত সীমান্তে ফরওয়ার্ড পলিসি গ্রহণ করে। অর্থাৎ চীন সীমান্তে সেনা চৌকি বসিয়ে নিজেদের এলাকা হিসেবে দাবি করতে থাকে। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভেবেছিল, এটি চীনকে চাপে ফেলবে এবং তারা পিছু হটবে। কিন্তু চীন এই পদক্ষেপকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা জমতে জমতে ১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর সকালে হঠাৎই সেই আগুন জ্বলে ওঠে।
চীনা সেনাবাহিনী সংগঠিত ও অভিজ্ঞ ছিল। তারা রাতের অন্ধকারে পাহাড় বেয়ে নেমে আসে। ভারতের লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশে একযোগে আক্রমণ শুরু হয়। ভারতীয় সেনারা প্রস্তুত ছিল না। তাদের ঠান্ডা প্রতিরোধের উপযুক্ত পোশাক, আধুনিক অস্ত্র বা পর্যাপ্ত রসদ কিছুই ছিল না।
কিছু অংশে সৈনিকরা পুরনো রাইফেল হাতে শত্রুর মোকাবিলা করছিল। লাদাখ অঞ্চলে চীনা বাহিনী আকসাই চিন পুরোপুরি দখল করে নেয়। অন্যদিকে অরুণাচলে তারা দ্রুত তাওয়াং, সেলা ও বমডিলা পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে।
ভারতের সেনাদের বীরত্বে ঘাটতি ছিল না, কিন্তু প্রস্তুতির অভাব ছিল প্রকট। অনেক সেনা গুলিতে নয়, ঠান্ডায় জমে মারা গিয়েছিলেন। পাহাড়ি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তখন ভারতীয় বাহিনীর তেমন ছিল না। আর তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বও যুদ্ধ পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। প্রধানমন্ত্রী নেহরু শুরুতে বিশ্বাসই করেননি যে চীন যুদ্ধ শুরু করবে। তিনি তখনো চিন্তা করছিলেন, কূটনীতির মাধ্যমে বিষয়টি মিটে যাবে।
এ সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে এক অস্থিরতা তৈরি হয়। যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী ও রাজনীতিকদের মধ্যে যথেষ্ট সমন্বয় ছিল না। সেনাপ্রধান ভি কে কৃষ্ণ মেননকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়, কারণ তিনি সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণে পিছিয়ে ছিলেন।
বিখ্যাত ব্রিটিশ সামরিক ইতিহাসবিদ নেভিল ম্যাক্সওয়েল ১৯৭০ সালে ‘India’s China War’ নামে একটি বই লিখেছিলেন, যা যথেষ্ট ‘বিতর্ক’ ছড়ায়। তিনি বলেন, ‘ভারত একধরনের মায়ার মধ্যে বাস করছিল। তারা ভাবছিল, চীন যুদ্ধ করবে না। কিন্তু চীন ধৈর্য হারিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে।’
নেভিল চীনের দিক থেকে যুদ্ধের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘চীন মনে করেছিল, সীমান্তে ভারতের অগ্রসরের মানে হচ্ছে তারা যুদ্ধ আহ্বান করছে।’
নেভিল ম্যাক্সওয়েলের এই ব্যাখ্যা নিয়ে ভারতীয় পাঠকদের মধ্যে তখন ব্যাপক ক্ষোভ জন্মে। কারণ ভারতীয়রা ভাবছিলেন, বইটি চীনের পক্ষ নিয়ে লেখা। কিন্তু বইটি এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রয়ে যায়, যেটি যুদ্ধের পেছনের রাজনীতি ও ভুল গণনার একটি বিশ্লেষণ দিয়ে যায়।
চীনা বাহিনী যেভাবে ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল তারা রাজধানী দিল্লি পর্যন্ত চলে আসবে। কিন্তু যুদ্ধ মাত্র এক মাস স্থায়ী হয়। ২১ নভেম্বর চীন একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে এবং ঘোষণা দেয়, তারা পূর্ব সীমান্তে ২০ কিলোমিটার পিছু হটবে। কিন্তু পশ্চিম সীমান্ত অর্থাৎ আকসাই চিনে তারা থেকে যায়। আজ পর্যন্ত আকসাই চিন চীনের দখলে রয়েছে, যদিও ভারত এখনো সেটিকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে।
চীনের যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত ছিল অদ্ভুত ও অবাক করার মতো। কেননা, তারা তখন জয়ী অবস্থায় ছিল। অনেক গবেষক বলেন, চীনের লক্ষ্য ছিল ভারতকে একটা শিক্ষা দেওয়া, যে তারা যেন ভবিষ্যতে সীমান্তে আগ্রাসী না হয়।
এশীয় ভূরাজনীতি নিয়ে কাজ করেন জার্মান গবেষক ড. টমাস বের্গার। তিনি বলেন, চীন জানত, সম্পূর্ণ যুদ্ধ করে ভারত দখল করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। তারা চেয়েছিল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে।
ভারতের পক্ষ থেকে এটি ছিল গভীর আত্মসমালোচনার সময়। জওহরলাল নেহরুর জনপ্রিয়তা হুমকির মুখে পড়ে। ১৯৬২ সালের পর ভারত সেনাবাহিনীতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। অস্ত্র আমদানি, পাহাড়ি যুদ্ধ প্রশিক্ষণ, সীমান্ত নিরাপত্তা সব ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ বাড়ে। ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সেই প্রস্তুতির ফলাফল দেখা যায়।
একটি যুদ্ধ কেবল বন্দুকের আওয়াজে গঠিত হয় না, তার রয়েছে গভীর মানসিক ও রাজনৈতিক ছায়া। ১৯৬২ সালের যুদ্ধ ভারতীয় জনমনে এক দীর্ঘস্থায়ী আঘাত রেখে গিয়েছিল। চীনকে ‘ভাই’ ভাবা বন্ধ হয়, কূটনৈতিক পরিভাষা থেকে ‘হিন্দি চিনি ভাই ভাই’ চিরতরে মুছে যায়। ভারত তখন থেকে চীনের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতে শুরু করে, এবং এই অবিশ্বাস আজও পুরোপুরি দূর হয়নি।
চীন অবশ্য এই যুদ্ধকে খুব বেশি বড় করে দেখতে চায় না। তারা বলে, এটি ছিল ‘সীমান্তে ছোটখাটো দ্বন্দ্ব’। কিন্তু ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ যুদ্ধ ছিল এক জাতীয় অপমানের অনুভব। সেনাদের আত্মবলিদান আর ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের এই মিশ্র ইতিহাস আজও ভারতের কূটনৈতিক চেতনায় গভীরভাবে ছাপ ফেলে আছে।
এই যুদ্ধের ছায়া এখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি। ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চীন সংঘর্ষ আমাদের সেই পুরনো দুঃখজনক অধ্যায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইতিহাস যেন ফিরে ফিরে আসে— কখনো রক্ত দিয়ে, কখনো বরফ দিয়ে।
আজ আমরা যখন ফিরে তাকাই ১৯৬২ সালের দিকে, তখন শুধু যুদ্ধ নয়, এক আত্মবিশ্লেষণের গল্পও দেখতে পাই। ভুল নীতির শিক্ষা, ভুল বন্ধু বাছাইয়ের খেসারত, আর সবচেয়ে বড় কথা— প্রস্তুতি ছাড়া শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় না, সে কথাই যেন হিমালয়ের ঢালে লেখা রয়েছে চিরকাল।
শীতল পাহাড়ের বুক চিড়ে যে আগুন একদিন হঠাৎ জ্বলে উঠেছিল, সেটি নিছক দুটি দেশের সীমান্ত দ্বন্দ্ব ছিল না। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে এক গভীর ছাপ ফেলেছিল।
সেই যুদ্ধ ছিল ধোঁয়াশার, অবিশ্বাসের আর আত্মতুষ্টির ফল। আর এই সবকিছুর মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল ভারতের তরুণ রাষ্ট্র এবং চীনের নবগঠিত কমিউনিস্ট শাসনের এক কড়াই ফুটন্ত সম্পর্ক। সেই যুদ্ধ শুধু রাইফেলের গুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, তার ছায়া পড়েছিল কূটনীতি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর সাধারণ মানুষের ভাবনাতেও।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন জওহরলাল নেহরু, স্বাধীন ভারতের রূপকারদের একজন। আর চীনের শীর্ষে ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা মাও সেতুং। দুই নেতার মধ্যে প্রথম দিকে বন্ধুত্বের বাতাবরণ থাকলেও সময়ের সঙ্গে সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরে।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর চীনের সঙ্গে একাধিক শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। ‘হিন্দি চিনি ভাই ভাই’ স্লোগান তখন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই সৌহার্দ্য যে এত তাড়াতাড়ি ভেঙে যাবে, তা কেউ কল্পনাও করেনি।
মুল বিরোধের শেকড় ছিল হিমালয়ের বরফঢাকা সীমান্তে। ভারতের উত্তর-পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ (তৎকালীন নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার অ্যাজেন্সি) এবং উত্তর-পশ্চিমে লাদাখের আকসাই চিন অঞ্চল ছিল এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রস্থল। ব্রিটিশ শাসনামলে গঠিত ম্যাকমাহন রেখা নামের এক কৃত্রিম সীমারেখা চীন কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি।
তাদের দাবি, ওই সীমারেখা অবৈধ এবং তিব্বতের অংশ ভারতের দখলে রয়েছে। অন্যদিকে ভারত বলছিল, এই রেখা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং চীন অহেতুক আগ্রাসন দেখাচ্ছে।
চীনের দিক থেকে আরও এক গভীর ক্ষোভ ছিল তিব্বত প্রসঙ্গ। ১৯৫৯ সালে চীন যখন তিব্বতে দমন-পীড়ন শুরু করে, তখন তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। ভারত সরকার তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়।
এ ঘটনাকে চীন দেখে ভারতীয় হস্তক্ষেপ হিসেবে। চীন বিশ্বাস করত, ভারত চায় তিব্বতের স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে। এই বিশ্বাস থেকেই দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ে।
ভারত সীমান্তে ফরওয়ার্ড পলিসি গ্রহণ করে। অর্থাৎ চীন সীমান্তে সেনা চৌকি বসিয়ে নিজেদের এলাকা হিসেবে দাবি করতে থাকে। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভেবেছিল, এটি চীনকে চাপে ফেলবে এবং তারা পিছু হটবে। কিন্তু চীন এই পদক্ষেপকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা জমতে জমতে ১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর সকালে হঠাৎই সেই আগুন জ্বলে ওঠে।
চীনা সেনাবাহিনী সংগঠিত ও অভিজ্ঞ ছিল। তারা রাতের অন্ধকারে পাহাড় বেয়ে নেমে আসে। ভারতের লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশে একযোগে আক্রমণ শুরু হয়। ভারতীয় সেনারা প্রস্তুত ছিল না। তাদের ঠান্ডা প্রতিরোধের উপযুক্ত পোশাক, আধুনিক অস্ত্র বা পর্যাপ্ত রসদ কিছুই ছিল না।
কিছু অংশে সৈনিকরা পুরনো রাইফেল হাতে শত্রুর মোকাবিলা করছিল। লাদাখ অঞ্চলে চীনা বাহিনী আকসাই চিন পুরোপুরি দখল করে নেয়। অন্যদিকে অরুণাচলে তারা দ্রুত তাওয়াং, সেলা ও বমডিলা পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে।
ভারতের সেনাদের বীরত্বে ঘাটতি ছিল না, কিন্তু প্রস্তুতির অভাব ছিল প্রকট। অনেক সেনা গুলিতে নয়, ঠান্ডায় জমে মারা গিয়েছিলেন। পাহাড়ি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তখন ভারতীয় বাহিনীর তেমন ছিল না। আর তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বও যুদ্ধ পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। প্রধানমন্ত্রী নেহরু শুরুতে বিশ্বাসই করেননি যে চীন যুদ্ধ শুরু করবে। তিনি তখনো চিন্তা করছিলেন, কূটনীতির মাধ্যমে বিষয়টি মিটে যাবে।
এ সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে এক অস্থিরতা তৈরি হয়। যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী ও রাজনীতিকদের মধ্যে যথেষ্ট সমন্বয় ছিল না। সেনাপ্রধান ভি কে কৃষ্ণ মেননকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়, কারণ তিনি সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণে পিছিয়ে ছিলেন।
বিখ্যাত ব্রিটিশ সামরিক ইতিহাসবিদ নেভিল ম্যাক্সওয়েল ১৯৭০ সালে ‘India’s China War’ নামে একটি বই লিখেছিলেন, যা যথেষ্ট ‘বিতর্ক’ ছড়ায়। তিনি বলেন, ‘ভারত একধরনের মায়ার মধ্যে বাস করছিল। তারা ভাবছিল, চীন যুদ্ধ করবে না। কিন্তু চীন ধৈর্য হারিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে।’
নেভিল চীনের দিক থেকে যুদ্ধের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘চীন মনে করেছিল, সীমান্তে ভারতের অগ্রসরের মানে হচ্ছে তারা যুদ্ধ আহ্বান করছে।’
নেভিল ম্যাক্সওয়েলের এই ব্যাখ্যা নিয়ে ভারতীয় পাঠকদের মধ্যে তখন ব্যাপক ক্ষোভ জন্মে। কারণ ভারতীয়রা ভাবছিলেন, বইটি চীনের পক্ষ নিয়ে লেখা। কিন্তু বইটি এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রয়ে যায়, যেটি যুদ্ধের পেছনের রাজনীতি ও ভুল গণনার একটি বিশ্লেষণ দিয়ে যায়।
চীনা বাহিনী যেভাবে ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল তারা রাজধানী দিল্লি পর্যন্ত চলে আসবে। কিন্তু যুদ্ধ মাত্র এক মাস স্থায়ী হয়। ২১ নভেম্বর চীন একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে এবং ঘোষণা দেয়, তারা পূর্ব সীমান্তে ২০ কিলোমিটার পিছু হটবে। কিন্তু পশ্চিম সীমান্ত অর্থাৎ আকসাই চিনে তারা থেকে যায়। আজ পর্যন্ত আকসাই চিন চীনের দখলে রয়েছে, যদিও ভারত এখনো সেটিকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে।
চীনের যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত ছিল অদ্ভুত ও অবাক করার মতো। কেননা, তারা তখন জয়ী অবস্থায় ছিল। অনেক গবেষক বলেন, চীনের লক্ষ্য ছিল ভারতকে একটা শিক্ষা দেওয়া, যে তারা যেন ভবিষ্যতে সীমান্তে আগ্রাসী না হয়।
এশীয় ভূরাজনীতি নিয়ে কাজ করেন জার্মান গবেষক ড. টমাস বের্গার। তিনি বলেন, চীন জানত, সম্পূর্ণ যুদ্ধ করে ভারত দখল করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। তারা চেয়েছিল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে।
ভারতের পক্ষ থেকে এটি ছিল গভীর আত্মসমালোচনার সময়। জওহরলাল নেহরুর জনপ্রিয়তা হুমকির মুখে পড়ে। ১৯৬২ সালের পর ভারত সেনাবাহিনীতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। অস্ত্র আমদানি, পাহাড়ি যুদ্ধ প্রশিক্ষণ, সীমান্ত নিরাপত্তা সব ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ বাড়ে। ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সেই প্রস্তুতির ফলাফল দেখা যায়।
একটি যুদ্ধ কেবল বন্দুকের আওয়াজে গঠিত হয় না, তার রয়েছে গভীর মানসিক ও রাজনৈতিক ছায়া। ১৯৬২ সালের যুদ্ধ ভারতীয় জনমনে এক দীর্ঘস্থায়ী আঘাত রেখে গিয়েছিল। চীনকে ‘ভাই’ ভাবা বন্ধ হয়, কূটনৈতিক পরিভাষা থেকে ‘হিন্দি চিনি ভাই ভাই’ চিরতরে মুছে যায়। ভারত তখন থেকে চীনের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতে শুরু করে, এবং এই অবিশ্বাস আজও পুরোপুরি দূর হয়নি।
চীন অবশ্য এই যুদ্ধকে খুব বেশি বড় করে দেখতে চায় না। তারা বলে, এটি ছিল ‘সীমান্তে ছোটখাটো দ্বন্দ্ব’। কিন্তু ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ যুদ্ধ ছিল এক জাতীয় অপমানের অনুভব। সেনাদের আত্মবলিদান আর ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের এই মিশ্র ইতিহাস আজও ভারতের কূটনৈতিক চেতনায় গভীরভাবে ছাপ ফেলে আছে।
এই যুদ্ধের ছায়া এখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি। ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চীন সংঘর্ষ আমাদের সেই পুরনো দুঃখজনক অধ্যায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইতিহাস যেন ফিরে ফিরে আসে— কখনো রক্ত দিয়ে, কখনো বরফ দিয়ে।
আজ আমরা যখন ফিরে তাকাই ১৯৬২ সালের দিকে, তখন শুধু যুদ্ধ নয়, এক আত্মবিশ্লেষণের গল্পও দেখতে পাই। ভুল নীতির শিক্ষা, ভুল বন্ধু বাছাইয়ের খেসারত, আর সবচেয়ে বড় কথা— প্রস্তুতি ছাড়া শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় না, সে কথাই যেন হিমালয়ের ঢালে লেখা রয়েছে চিরকাল।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ মরক্কোতে কাল শুক্রবার (৬ জুন) উদযাপিত হবে পবিত্র ঈদুল আজহা। এদিন বিশ্বের সব মুসল্লি পশু কোরবানি করে থাকেন। তবে মুসলিম প্রধান দেশ মরক্কোতে এ বছর কোরবানি না দিতে রাজকীয় ডিক্রি (সরকারি আদেশ) জারি করা হয়েছে।
১ দিন আগেভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের বাসিন্দা সোনা বানুর বয়স ৫৮ বছর। গত ২৫ মে তাঁকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে ডেকে পাঠানো হয়। সেখান থেকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তিনিসহ মোট ১৪ জনকে ঠেলে (পুশ ইন) পাঠানো হয় বাংলাদেশে।
২ দিন আগেগাজায় অব্যাহত ইসরায়েলি হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও প্রায় ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বুধবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে (ইউএনএসসি) এক যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রস্তাবটিতে গাজায় অবিলম্বে, নিঃশর্ত ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছিল। খবর আলজাজিরার।
২ দিন আগেজাতীয় নিরাপত্তার কারণে ১২টি দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বুধবার দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছেন।
২ দিন আগে