খবর ও বিজ্ঞাপন একে অন্যের পরিপূরক

অনেক পাঠকই সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেখে বিরক্ত হন। নিউজ পোর্টালে বিজ্ঞাপন তাদের একেবারেই অপছন্দ। তারা শুধু খবরই পড়তে চান প্রচলিত সংবাদপত্র আর নিউজ পোর্টালে। কিন্তু এমন সংবাদপত্র কি আছে, যেখানে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় না? বিজ্ঞাপনহীন নিউজ পোর্টালও সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সংবাদপত্র আর নিউজ পোর্টালে এই যে রাশি রাশি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়, এর কারণ কী? কেন প্রকাশিত হয় বিজ্ঞাপন? কী প্রয়োজন বিজ্ঞাপন প্রকাশ করার? অনেক পাঠকের ভাবনার মধ্যে তা হয়তো নেই।
পাঠকই সংবাদপত্র আর নিউজ পোর্টালের প্রাণ। পাঠকের জন্যই তো সাংবাদপত্র কিংবা নিউজ পোর্টাল। পাঠকের খবরের ক্ষুধা মেটাতে অহর্নিশি ব্যস্ত সংবাদ কর্মীরা। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই পাঠককে হালনাগাদ খবর দিতে তৎপর তারা। পাঠককে সার্বক্ষণিকভাবে তথ্য সমৃদ্ধ রাখা, পাঠকের মনোরঞ্জন করাই সংবাদপত্র আর নিউজ পোর্টালের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।
পাঠকের চাওয়ার সীমা-পরিসীমা নেই। যত ভিন্ন মানুষ, তত আলাদা দৃষ্টিভঙ্গী, তত বিচিত্র কৌতূহল, তত পল্লবিত চাহিদা। কেউ পড়তে চায় রাজনীতির খবর, কেউ খেলার খবর, কেউ অপরাধের খবর। কারও চোখ আটকে থাকে সাহিত্যের পাতায়, কারও মন টানে সাংস্কৃতিক খবরে। মানবিক আবেদনধর্মী খবরে কিংবা ফিচারে আগ্রহ অনেকের। কেউ বা দূর গ্রামের খবর পড়ার অপেক্ষায় থাকেন, কেউ সারা বিশ্বের খবর পড়তে চান। কারও আগ্রহ দেশের খবরে, ব্যবসা-বাণিজ্যের খবরে কারও মন। কারো মন টানে দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র তারকাদের খবরে। রগরগে ছবির প্রতি আগ্রহ অনেকের।
খুন-খারাপি, ছিনতাই-ডাকাতি, দুর্ঘটনা, সামাজিক কেলেংকারি, দুর্নীতি, জনজীবনে দুর্ভোগের খবর অনেক পাঠককেই ব্যথিত করে। তবু এসব খবরেই তার গভীর আগ্রহ। আবার অনেকে শুধু খবর পড়েই সন্তুষ্ট নন, তারা চান খবরের বিশ্লেষণ, সংবাদ পর্যালোচনা। পাঠকের বিচিত্র কৌতূহল যোগ করলে দেখা যাবে, তারা খবরের কাগজে, নিউজ পোর্টালে পরিবার, সমাজ, দেশই শুধু না গোটা পৃথিবীকে দেখতে চান।
পাঠকের হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করা সহজ কাজ নয়। কোনো কোনো খবরের কাগজ কিংবা নিউজ পোর্টাল খুব সহজেই পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। আবার অনেক সংবাদপত্র আর নিউজ পোর্টাল খবরের বর্ণাঢ্য ডালি সাজিয়েও পাঠকের উপেক্ষার মধ্যেই পড়ে থাকে।
আমাদের সামাজিক পরিভাষায় বলা যেতে পারে, পাঠক যেন নাক-উঁচু পাত্রপক্ষ। আর সংবাদপত্র বা নিউজ পোর্টাল যেন বিনীত কন্যাপক্ষ। অনেক কিছু দিয়েও পাত্রপক্ষের মন ভারানো যায় না। কন্যাপক্ষের নানা খুঁত খুঁজতেই থাকে পাত্রপক্ষ। তাই নানা কৌশলে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা চলে, চলতেই থাকে।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা অভিযোজনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে সংবাদপত্র। শুধু ছাপানো সংবাদপত্র দিয়ে এখন আর সব শ্রেণির পাঠকের কাছে পৌঁছানো যায় না। পাঠকের মন ভরে না। পাঠক এখন প্রতি মুহূর্তে আপ-টু-ডেট থাকতে চায়। খবরের সঙ্গেই থাকতে চায়। নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে পাঠকের হাতের মুঠোয় এখন খবর। কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর অতি দ্রুত সেই খবর পৌঁছে যায় পাঠকের কাছে। মোবাইল ফোন আর বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া এ প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করে দিয়েছে।
যেভাবেই হোক পাঠকের কাছে পৌঁছানোই সংবাদপত্র আর নিউজ পোর্টালের লক্ষ্য। পাঠকের কাছে খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য তো মুদ্রিত সংবাদপত্রের বিনিময় মূল্যর দরকার হয়। কিন্তু যে বিনিময় মূল্য পায় তা দিয়ে সংবাদপত্রের বেঁচে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই বেঁচে থাকার বিকল্প খুঁজতে হয়। তবে সে বিকল্পও পাঠকের ওপর ভর করেই খুঁজে নিয়েছে সংবাদপত্র।
মুদ্রিত সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টালের পাঠক বিভিন্ন পণ্যেরও ক্রেতা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের প্রচার-প্রসারের জন্য সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টালের আশ্রয় নেয়। নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টাল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তথ্য প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টালে। এই বিজ্ঞাপন প্রকাশই সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টালের আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে উঠে।
সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টালকে ভর করে বিজ্ঞাপন পৌঁছে যায় পাঠকের কাছে। আর পাঠক খবরের পাশাপাশি বিজ্ঞাপন থেকে হাতের কাছে পেয়ে যায় প্রয়োজনীয় তথ্য। আবার মুদ্রিত সংবাদপত্রের এমন গ্রাহকও আছেন যারা বিজ্ঞাপন দেখার জন্যই সংবাদপত্র পড়েন। সংবাদপত্র কেনেন। খবর পড়া তাদের কাছে গৌণ। অনেকটা রথ দেখা, আর কলা বেচার মতো।
প্রকাশনার আদিযুগ থেকেই মুদ্রিত সংবাদপত্রের সঙ্গে খবর আর বিজ্ঞাপনের অনুষঙ্গ গড়ে উঠেছে। শতবর্ষের পুরোনো খবরের কাগজ ঘাটলেও একই চিত্র দেখা যায়। শুধু কি তাই, এমনও সময় ছিল যখন প্রতিদিন সংবাদপত্রের প্রথম পাতাটাই সাজানো হতো শুধু বিজ্ঞাপন দিয়ে। ছোট-বড় ১৫-২০টি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতো প্রথম পৃষ্ঠায়। খবর সাজানো হতো দ্বিতীয় পৃষ্ঠা থেকে। ইদানিং হঠাৎ হঠাৎ কোনো সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে বড় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতে দেখা যায়। প্রচীন সংবাদপত্র থেকেই হয়তো এই কৌশলটি এসেছে। তবে প্রচীন সংবাদপত্রে প্রথম পৃষ্ঠায় একাধিক বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতো, এখন প্রকাশিত হয় শুধু একটি বিজ্ঞাপন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় বিজ্ঞাপনের ধরন, বদলে যায় বৈশিষ্ট্য, বিষয়বস্তু। সংবাদপত্র পাঠকের চাহিদার সঙ্গে বদলে যায় বিজ্ঞাপনের শ্রেণি। একসময় যে বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব সংবাদপত্র পাঠকের কাছে ছিল অপরিসীম, আজকের পাঠকের কাছে তা হাস্যকরও মনে হতে পারে।
মজুত স্টক থেকে গমের ভুষি বিক্রির বিজ্ঞাপন নিয়মিত প্রকাশিত হতো ষাটের দশকের সংবাদপত্রে। এসব বিজ্ঞাপনে ভুষির মূল্য ও প্রাপ্তিস্থান উল্লেখ থাকত। নারিকেলের ছোবড়া বিক্রির বিজ্ঞাপনও নিয়মিত দেখা যেত। আগ্রহীদের নারকেলের ছোবড়া কেনার ‘অপূর্ব সুযোগ’ নেওয়ার আহ্বান জানানো হতো ওই বিজ্ঞাপনে।
আজকাল রেডিওর ব্যবহার খুবই কমে গেছে। রেডিও সেট সচর-আচর দেখাই যায় না। অথচ একসময় রেডিও ছিল শক্তিশালী গণমাধ্যম। আর তাই হয়তো রেডিও সেট বিক্রির সচিত্র বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে নিয়মিত প্রকাশিত হতো।
বিজ্ঞাপনের কনন্টেন্টও থাকতে বেশ আকর্ষণীয়। দর্শক আকৃষ্ট করার জন্য সিনেমার চটকদার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতো সংবাদপত্রে। সংবাদপত্রের একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে শুধু সিনেমার বিজ্ঞাপনই প্রকাশিত হতো। এখন আর তা খুব বেশি চোখে পড়ে না।
ষাটের দশকে ভারতীয় সিনেমা থেকে দর্শকদের দৃষ্টি ফেরানোর কৌশল হিসেবে অনেক সিনেমার বিজ্ঞাপনে লেখা হতো— ‘যেকোনো প্রথম শ্রেণির ভারতীয় ছবির সমতুল্য’। পঞ্চাশের দশকে একটি কাগজ তৈরি কারখানার বিজ্ঞাপন ছিল বেশ চমকপ্রদ। তাদের বিজ্ঞাপনে কোনো দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আবার কোনোদিন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি ব্যবহার হতো। প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরা হতো দেশের উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের অবদান ও জ্ঞানচর্চার সঙ্গে কাগজের সম্পর্কের কথা। আর এই কাজে সংশ্লিষ্ট কাগজ কারখানার ভূমিকাকে সম্পর্কিত করা হতো এই বিজ্ঞাপনে।
কিছু বিজ্ঞাপনে অশালীনতার ছাপও পড়েছে কখনো কখনো। প্রাচীন সংবাদপত্রে সম্ভবত এর নজির বেশি ছিল। উপমহাদেশের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট। ১৭৮০ সালে প্রকাশিত এই খবরের কাগজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন জেমস অগাস্টাস হিকি। ‘হিকির গেজেট’ নামে পরিচিত এই খবরের কাগজে প্রকাশিত একটি অশালীন বিজ্ঞাপন নিয়ে এখনো আলোচনা হয়।
ওই বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল— ‘এখন কলকাতাবাসী জনৈক ভদ্রলোক দুটি দুদেহী আফ্রিকান— যাদের কথ্য ভাষায় ‘কাফরি’ বলা হয়— মেয়েছেলে চান। তাদের বয়স ১৪ থেকে ২০-২৫-এর মধ্যে হতে হবে। গড়ন বেশ হৃষ্টপুষ্ট হওয়া দরকার। সব রকমভাবে যাতে দেহভোগের কাজে লাগে সেই রকম হতে হবে।’
সমকালীন সংবাদপত্রে এ ধরনের বিজ্ঞাপন আর প্রকাশিত হয় না। তবে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন আহ্বান করে বিজ্ঞাপন প্রকাশের নজিরও রয়েছে। নির্ধারিত কোনো স্থান শূন্য রেখে সেখানে প্রকাশের জন্য বিজ্ঞাপন আহ্বান করা হয়েছে। আর সেই নির্ধারিত স্থানটিতে লেখা হয়েছে— ‘বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের অসংখ্য পাঠককে আপনার ক্রেতা করুন’।
সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টালকে ভর করে খবর পৌঁছে যায় পাঠকের কাছে। সেই সঙ্গে পৌঁছে যায় বিজ্ঞাপনও। খবর ও বিজ্ঞাপন একে অন্যের পরিপূরক হয়ে পাঠকের কাছে হাজির হয়। সংবাদপত্রের সঙ্গে খবর ও বিজ্ঞাপনের এই মেলবন্ধন হয়তো চিরন্তন। অতীতের মতো ভবিষ্যতেও হয়তো খবরের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের ডালি সাজিয়েই সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টাল পাঠকের কাছে হাজির হবে। হতেই থাকবে।
লেখক: সাংবাদিক ও গণমাধ্যম গবেষক; সাবেক পরিচালক (গবেষণা ও তথ্য সংরক্ষণ), প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)