অফিসিয়াল ড্রেস কোড

অফিস ও অফিসের বাইরে, ঘরে ও ঘরের বাইরে, খেতে-ঘুমাতে-খেলাধুলায় কিংবা বেড়াতে— সবখানেই আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক ড্রেস কোড আছে। এগুলো সবসময় আমরা মেনে চলি, এমন নয়। তবে অবস্থা অনুযায়ী মানতে পারলে ভালো। না পারলে অনেক সময় ভুগতে হতে পারে।
পোশাক নিয়ে অনেক গল্প আছে। শেখ সাদীর সেই গল্প তো জগদ্বিখ্যাত। একবার এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে গিয়েছিলেন দাওয়াত খেতে। তিনি সাধারণ পোশাকে ছিলেন। যারা খাবার দিচ্ছিলেন, তারা সাধারণ পোশাকধারী দেখে শেখ সাদীকে অবহেলা করেছিলেন। সাদী সেখান থেকে চলে যান। অন্য আরেকদিন খুব ধোপদুরস্ত পোশাক পরে সেই একই বাড়িতে গেলেন সাদী। এবার তাকে খুব খাতির-যত্ন করা হলো। তিনি ভালো-ভালো খাবারগুলো পকেটে ভরতে লাগলেন। সবাই অবাক হয়ে চিৎকার করে উঠল, হায়! সাদী করছেন কী! সাদী বললেন, ‘খাবার তো পোশাকের জন্য, তাই পোশাককেই খাওয়াচ্ছি। এর আগে একবার এসেছিলাম। সাধারণ পোশাক ছিল বলে আমাকে তো পাত্তাই দেওয়া হয়নি।’
আমাদের সময়ের একটা সত্য ঘটনা বলি। ১৯৯১ সালে যিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন, কিছুদিন পর তার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ল। চাপ কমানোর জন্য সরকার এ মন্ত্রণালয়ে একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দিতে চাইলেন। সেখানে যার নাম মনোনীত হলো, গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হলো— তিনি ড্রেসকোড সম্পর্কে অজ্ঞ। শেরাটন হোটেলে নাকি একটি ডিনারে তিনি গিয়েছিলেন গাঢ় রঙের পোশাকের পরিবর্তে হালকা রঙের স্যুট পরে। ডিনারে গাঢ় রঙের পোশাক পরার কথা ছিল।
আরেকটি ঘটনা গণমাধ্যমে খুব চালাচালি হয়েছিল ২০২১ সালে। ১৭ মার্চ একটি সরকারি অনুষ্ঠানে পুলিশের নির্দিষ্ট ড্রেস কোড অনুসরণ না করায় রাজশাহীর কাটাখালীর ওসিকে সদর দপ্তর থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

সরকারি অফিসে ড্রেস কোড নিয়ে ২০০৯ সালের পরিপত্র
দুই.
বিবর্তনবাদীরা মনে করেন, মানুষ প্রথম জীবনে নগ্ন ছিল। কিন্তু দুনিয়ার প্রথম মানুষ আদম (আ.) পোশাক পরেই জান্নাত থেকে পৃথিবীতে এসেছিলেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে আদম সন্তান, লজ্জা ঢাকতে এবং বেশ ভূষার জন্য আমি তোমাদের পোশাক দিয়েছি। [সূরা আরাফ, আয়াত ২৬] সুতরাং প্রথম জীবনেও মানুষ নগ্ন ছিল না।
বাংলা ভাষার প্রাচীন কাব্য চর্যাপদেও পোশাকের কথা আছে। বালিকারা ময়ূরপুচ্ছ পরিধান করত। এ ‘পুচ্ছ’ নিশ্চয়ই শরীরে আবৃত কোনো পোশাকের ওপরেই পরা হতো। বিশ্ব পর্যটক আলবেরুনী যখন উপমহাদেশে এসেছিলেন, তিনি লক্ষ করেছিলেন যে প্রাচীন এ দেশে হিন্দু-মুসলমানের পোশাক আলাদা আলাদা। [আলবেরুনীর ভারততত্ত্ব, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ আনূদিত, পৃষ্ঠা ৭]
মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরামও তার কাব্যে মুসলিমদের সাদা পোশাক, পায়জামা ও শেরওয়ানির কথা উল্লেখ করেছেন। [চণ্ডীমঙ্গলকাব্য, পৃষ্ঠা ১১৭]
নীহাররঞ্জন রায় প্রাচীন বাঙালির যে পোশাকরীতির বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায় যে ‘লেংটি’ বা ‘নেংটি’ ছিল বাঙালির প্রধান পোশাক’। [বাঙ্গালির ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৪৫৮] ছোট আকারে ধুতি বা হাটুর ওপরে মালকোঁচা হলো লেংটি। [বৃহৎবঙ্গ, পৃষ্ঠা ৫৯০] উপমহাদেশের জনপ্রিয় নেতা মহাত্মা গান্ধী এই অর্ধ-উলঙ্গ পোশাকই জীবনের শেষ পর্যন্ত পরেছেন। কিন্তু মুসলমানদের জন্য যেহেতু শরীর ঢেকে রাখা ফরজ, তাই তাদের পোশাক প্রথম থেকেই ছিল শরীর আবৃত করে রাখা ‘পরিপূর্ণ পোশাক’।
তিন.
আমাদের দেশে প্যান্ট-শার্ট, স্যুট-টাইয়ের আগমন ১৭৫৭ সালের পর। এ পোশাকের আমদানিকারক ইংরেজ শাসকদল। দীনেশচন্দ্রসেন এ পোশাক সম্পর্কে ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘প্যান্ট-ট্রাউজার কতকটা বালিশের খোলের মতো, দরজিই সমস্ত কাজ করিয়ে দেয়, যিনি পরিবেন, তিনি পা দুটি ঢুকাইয়া দিলেই তাহার কাজ শেষ হয়’। [বৃহৎবঙ্গ, পৃষ্ঠা ৫৯১]
ইংরেজ আমলে সবাই যে এর অনুসরণ করেছে, তা নয়। জওহরলাল নেহেরু শেরওয়ানিই পরতেন। জিন্নাহ ছিলেন দোলাচলে— শেরওয়ানি, স্যুট-টাই দুটোই পরেছেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক আবার আজীবন শেরওয়ানি। তবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্যুট-টাই ছাড়েননি। ঠিক যেমন মাওলানা ভাসানী লুঙ্গিতেই অবিচল ছিলেন আজীবন, সদূর ইউরোপ পর্যন্ত চলে গেছেন লুঙ্গি পরেই।
১৯৪৭ সালে শেরওয়ানি-স্যুট পাশাপাশি চলেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্যুট ছেড়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরতে শুরু করেছিল। [অনীল মুখার্জি, স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রামের পটভূমি, পৃষ্ঠা ১৬৯]
বাঙালি নারীরা প্রথম থেকেই শরীর আবৃত করা পোশাকে অভ্যস্ত ছিল। বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনাসহ বাঙালি নেতা-বুদ্ধিজীবীরা শাড়ি ও ঘোমটাতেই সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।
শেখ মুজিব পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে শেরওয়ানি পরলেও ষাটের দশক থেকে তিনি পাজামা-পাঞ্জাবির ওপরে কালো-কটি জড়িয়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ ‘সাফারি’ নামক এক পোশাক পরতেন। সরকারি আমলারা কিছুদিন এর অনুসরণ করলেও এর ধারাবাহিকতা থাকেনি।

সরকারি অফিসে ড্রেস কোড নিয়ে ২০১৩ সালের পরিপত্র
চার
স্যুট-টাই আমাদের দেশে অফিস ড্রেস কোড হয়েছিল ইংরেজদের হাত ধরে। ইংরেজরা চেয়েছিল এ দেশে এমন একটি গোষ্ঠী থাকবে, যারা রক্তে-মাংসে এ দেশীয় হলেও চিন্তায়-চেতনায় হবে ইংরেজ। এটা সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয় আমলাতন্ত্রে। ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে সিএসপিতে (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) পরিণত হয় আপনাআপনিই। ড্রেস কোড হিসেবেও পাকিস্তানে অব্যাহত থাকে ইংরেজদের স্যুট-টাই। ১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশেও একই ড্রেস কোড অব্যাহত থাকে। অল্প কিছুদিন ‘খদ্দর’ চলেছিল, শেষ পর্যন্ত প্যান্ট-শার্ট আর স্যুট-কোট-টাইয়েই তা থিতু হয়।
১৯৮২ সালের ১৭ মে নতুন সামরিক সরকার একটি পরিপত্র জারি করে। তাতে বলা হয়, পুরুষ কর্মকর্তাদের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত স্যুট-টাই না পরে অফিসে প্যান্ট-শার্ট (অর্ধ হাতা অথবা পুরো হাতা) পরতে হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেসব কর্মকর্তা, যারা এতদিন পাজামা-পাঞ্জাবি পরছিলেন। তাদেরও নতুন পরিপত্র অনুযায়ী পাজামা-পাঞ্জাবি ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট নতুন করে বানাতে হয়। কিন্তু এরপরও কর্মকর্তারা স্যুট-টাই ছাড়েননি।
২০০৯, ২০১২ ও ২০১৩ সালেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কর্মকর্তাদের ড্রেস কোডের সংশোধন হয়েছে। ২০১৭ সালের ৫ মার্চ জারি করা এক পরিপত্রে আবারও মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত স্যুট-টাই না পরে প্যান্ট-শার্ট পরতে বলা হয়। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর আরেক পরিপত্রে কর্মকর্তাদের মতামত চাওয়া হয় এই বলে যে, ২০১৩ সালের ১৩ মে ‘এয়ারকুলার ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও আবহাওয়া অনুযায়ী অফিসে পোশাক পরিধান সংক্রান্ত পরিপত্র সংশোধনের প্রয়োজন আছে কি না।’
নারী কর্মকর্তারা ঐতিহাসিকভাবেই অফিসে শাড়ি পরে আসছিলেন। কিন্তু অধিকতর কর্মতৎপরতা চালিয়ে যেতে নারী কর্মকর্তাদের সালোয়ার-কামিজ অফিস আদেশ ছাড়াই জনপ্রিয় হয়ে গেছে।
পাঁচ.
পোশাক নারী-পুরুষ সব পেশাজীবীরই ব্যক্তিত্ব প্রকাশের মাধ্যম। সে কারণে স্থানভেদে, অনুষ্ঠানের তারতম্যে পোশাক নির্বাচন করতে হয়। গরম এলাকায় হালকা পরিধান উত্তম, শীতপ্রধান এলাকায় কোট, প্রিন্সকোট, শেরওয়ানি শ্রেয়। শোকের অনুষ্ঠানে চকমকে কাপড় বেমানান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঙালিয়ান অথবা নৃ জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির পোশাক উৎসবের মেজাজ এনে দেয়। ক্লাসে পড়াতে গেলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পোশাকে ব্যবধান থাকা বাঞ্ছনীয়। ছাত্ররা টি-শার্ট, গেঞ্জি পরে ক্লাসে এসেছে বলে শিক্ষকও এভাবে আসবেন— এটা বেমানান।
পার্টি, মধ্যাহ্নভোজ, নৈশভোজ, সকালের নাশতা ইত্যাদির দাওয়াতপত্রে খেয়াল করবেন, পোশাকের কথা কিছু লেখা রয়েছে কি না অনেক কার্ডের শেষে লেখা থাকে— Dress: Casual or Formal। Casual লেখা থাকলে আপনি ঘরোয়া বা আটপৌরে যেকোনো পোশাক পরেই যেতে পারেন। তবে Formal লেখা থাকলে আনুষ্ঠানিক ও প্রথানুসারী পোশাক পরবেন, এটাই কাম্য। মধ্যাহ্ন আহারে হালকা রং চলবে, তবে নৈশভোজে গাঢ় রঙের পোশাক শ্রেয়। জুতোর দিকে খেয়াল রাখবেন, বড় হোটেলে চামড়ার জুতোই পরে যাবেন। স্যান্ডেল, কেডস মানানসই নয়। কোথাও কোথাও আবার পা খোলা কোনো ধরনের জুতোই গ্রহণযোগ্য নয়।
ছয়.
সরকারি অফিসের ড্রেস কোড ও করপোরেট অফিসের ড্রেস কোড এক হবে না। করপোরেট অফিসে আরামদায়ক ও কাজে গতি থাকে এমন পোশাকই অনুমোদিত। এ ক্ষেত্রে স্যুট-টাই না পরে প্যান্ট-শার্ট বা পাজামা-পাঞ্জাবির ওপরে ব্লেজার সৌন্দর্য আনে। মেয়েরাও এখন ব্লেজার পরে থাকেন। তাই কোথায় কাজ করছেন, সেখানকার পরিবেশ কেমন— এসব বুঝে পোশাক নির্ধারণ করুন।
পোশাক নিয়ে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতাও স্বাস্থ্যকর নয়। প্রতিদিন পোশাক বদলানো ঠিক নয়। অলঙ্কার পরিহার করা নিরাপদও। আবার প্রতিদিনই জিজ্ঞাসা করবেন না— এ পোশাকে আমাকে কেমন লাগছে!
লেখক: গবেষক ও লেখক