খসড়ায় নীতিগত সম্মতি, ধর্ষণ মামলার বিচারে যেসব সংশোধনী আসছে আইনে

ধর্ষণের ঘটনায় দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে আইন সংশোধনের কথা আগেই জানিয়েছিলেন আইন উপদেষ্টা। ধর্ষণ মামলার তদন্তের সময়ের পাশাপাশি বিচার সম্পন্ন করার সময়ও কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন তিনি। বিচারকাজ সহজ করতে আইনের আরও কিছু জটিলতা নিরসন করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
এসব বিষয়ের ওপর আলোচনার মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত করেছে সরকার। এরই মধ্যে সংশোধনীর খসড়ায় উপদেষ্টা পরিষদ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে মিলতে পারে সংশোধনীতে চূড়ান্ত অনুমোদন। এরপর অধ্যাদেশ জারি করে সংশোধনীগুলো কার্যকর করা হবে।
দেশ জুড়ে গত কয়েক দিন ধরেই আলোচিত ধর্ষণ এবং নারী নিপীড়ন ও হয়রানির নানা ঘটনা। এর মধ্যে বিশেষভাবে সাড়া ফেলেছে মাগুরায় আট বছর বয়সী শিশুর ধর্ষণ, যে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আট দিন হাসপাতালের শয্যায় লড়াইয়ের পর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে।
এসব ঘটনায় দেশ জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। অধিকার কর্মীরা ছাড়াও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছে তরুণ সমাজ, শামিল হয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। সরকারও ধর্ষণের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা জানিয়েছে, জানিয়েছে ধর্ষণের ঘটনায় দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে আইন সংশোধনের কথা।
সোমবার (১৭ মার্চ) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ এক সভায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কিছু সংশোধনী প্রস্তাবে সরকার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। সোমবার (১৭ মার্চ) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
একই ব্রিফিংয়ে অন্তর্বর্তী পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আইনটির সংশোধনীর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার এই আইনটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদন পেতে পারে।

যা থাকছে আইনের সংশোধনীতে
দুই উপদেষ্টার ব্রিফিংয়ের তথ্য বলছে, ধর্ষণের সংজ্ঞাসহ শাস্তির বিধানে বেশ কিছু পরিবর্তন রয়েছে সংশোধনী প্রস্তাবে। এ ক্ষেত্রে কেবল পুরুষ কর্তৃক নয়, বরং যেকোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণকেই শাস্তিযোগ্য করা হচ্ছে। অর্থাৎ ধর্ষক হিসেবে যে কেউ অভিযুক্ত হতে পারেন।
ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলাৎকারকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কেবল পেনিট্রেশন নয়, অন্য কোনো বস্তু ব্যবহার করে বা পায়ুপথে বা যেকোনোভাবেই যদি ধর্ষণ করা হয়, সেটিও ধর্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, বলৎকারকেও এখানে যুক্ত করা হয়েছে। যেকোনোভাবে ধর্ষণ করা হলে সেটি ধর্ষণের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। ধর্ষণের সময় যদি কেউ আঘাত পান বা ধর্ষণের উদ্দেশ্যে যদি জখম করা হয়, সেটিরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থার বিধানও থাকছে।
মামলার জট এড়াতে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সম্মতি নিয়ে প্রতারণামূলক ধর্ষণ এবং সম্মতি ছাড়া ধর্ষণের অপরাধ আলাদা করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সম্মতি নিয়ে প্রতারণামূলক যেসব ঘটনা, আমরা বিধান করেছি, সে ঘটনাগুলো আলাদা অপরাধ। আর সম্মতি ছাড়া ধর্ষণের যেসব ঘটনা, এগুলো আলাদা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সম্মতি ছাড়া ধর্ষণের যেসব ঘটনা, এগুলোর বিচার ও তদন্তের সময় কমানো হয়েছে। এ মামলাগুলোর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত করার জন্য বেশকিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে আইনে। সংশোধনীর খসড়া অনুযায়ী, ধর্ষণের মামলা তদন্তের সময় ৩০ দিন থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা হচ্ছে। এ ছাড়া ধর্ষণ মামলার বিচারকাজ শেষ করার জন্য আগে ১৮০ দিন সময় নির্ধারণ করা ছিল। সেই সময় কমিয়ে ৯০ দিন করা হচ্ছে।
এর বাইরে শিশু ধর্ষণের মামলা আলাদাভাবে বিচার করার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের বিধানও রাখা হচ্ছে সংশোধনীতে। এই ট্রাইব্যুনাল কেবল শিশু ধর্ষণের মামলাগুলোই বিচার করবে। উপদেষ্টারা সবাই নীতিগতভাবে এ বিষয়ে সম্মত হয়েছেন।
ধর্ষণ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা ছিল ডিএনএ প্রতিবেদন। বর্তমানে দেশে কেবল ঢাকাতেই একটি ডিএনএ ল্যাব রয়েছে, যেখান থেকে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।
এ ক্ষেত্রে সংশোধনীতে বিধান যুক্ত করা হচ্ছে, বিচারক যদি মনে করেন তাহলে ডিএনএ প্রতিবেদন ছাড়াই মেডিকেল সনদ ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলার বিচারকাজ চালিয়ে নিতে পারবেন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, ডিএনএ রিপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষায় অনেক মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকত। এ কারণেই আমরা এই বিধানটি সংশোধন করছি। আদালত চাইলে মেডিকেল সনদ ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন ছাড়াই মামলা দ্রুত বিচার করতে পারবেন।
আইনের সংশোধনী ছাড়াও ধর্ষণ মামলাকে গুরুত্ব দিয়েই দেশে আরও দুটি ডিএনএ ল্যাব স্থাপনেও নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছেন উপদেষ্টারা। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে এই দুটি ডিএনএ ল্যাব স্থাপন করা হবে।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এই মুহূর্তে ডিএনএ ল্যাব আছে ঢাকায়। আজ (সোমবার) সিদ্ধান্ত হয়েছে, দ্রুততার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে আরও দুটি ডিএনএ ল্যাব স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া বিশেষ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে দ্রুত কিছু বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে, যেন ধর্ষণসহ অন্যান্য মামলার বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা যায়।
সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’-এর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হলে উপদেষ্টা পরিষদ তাতে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এ নিয়ে এরই মধ্যে কিছু মতামত পাওয়া গেছে। প্রস্তাবগুলো কাল-পরশুর মধ্যে যাচাই-বাছাই করা হবে। এরপর বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদে তা চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হবে বলে আশা করছি।