বিবিসি বাংলা
বাংলাদেশে গত বছর অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এক বছর পার হলেও অপরাধ কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি সরকার। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো কেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না- সেই প্রশ্ন গত কিছুদিন ধরেই আলোচনায় আসছে।
সম্প্রতি সমালোচনার মুখে সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে দাবি করা হয়েছে যে 'চলতি বছর বড় ধরনের অপরাধের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য বেড়েছে-এই দাবি সঠিক নয়। এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা স্থিতিশীল আছে'।
পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা অবশ্য বিবিসির কাছে স্বীকার করেছেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রায় ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনীকে পুরোপুরি সক্ষম করে তোলার জন্য তারা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এমনকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে 'ডেভিল হান্ট' কিংবা 'চিরুনি অভিযানের' মতো কর্মসূচির কথা সরকার বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হলেও সেগুলো কতটা কাজে এসেছে তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
অথচ গত এক বছর ধরেই দেশজুড়ে সেনাবাহিনীও মোতায়েন রাখা হয়েছে।
তবে এতদিন 'মব' সন্ত্রাস বা কিছু লোক জড়ো হয়ে হামলা বা চাঁদাবাজির মতো ঘটনাগুলো নিয়ে এক ধরনের 'দেখেও এড়িয়ে' যাওয়ার অভিযোগ ছিল। সম্প্রতি গুলশানে একজন সাবেক এমপির বাড়ি থেকে সমন্বয়ক পরিচয় চাঁদা আদায়ের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের ঘটনাকে এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে 'প্রথমবারের মতো পুলিশের কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ' হিসেবে অনেকে বিবেচনা করছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারা, কিছু ঘটনায় কর্তৃপক্ষের মৌন থাকা, আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর প্রতি ভয় কমে যাওয়া এবং বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশের মধ্যেই আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরি হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যায়নি।
তবে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশনস) মো. রেজাউল করিম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে পুলিশ এখন সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করছে এবং এর ফলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়ে এসেছে।
"অপরাধমূলক কোনো ঘটনাই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না–– এটি নিশ্চিত করা হচ্ছে। কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মানবাধিকার সমুন্নত রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে যা যা করণীয় সেটিই এখন করা হচ্ছে," বলছিলেন তিনি।
সহিংস অপরাধের সংখ্যা বাড়েনি: প্রেস উইং
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গত ১৪ই জুলাই এক বিবৃতিতে বলেছে, চলতি বছর দেশে অপরাধের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে—বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবরে জনমনে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে।
"২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সরকারি অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছর বড় ধরনের অপরাধের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে—এমন দাবি সঠিক নয়"।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ মাসে বড় ধরনের অপরাধের প্রবণতা স্থিতিশীল রয়েছে। পরিসংখ্যানে বড় ধরনের অপরাধ দ্রুত বাড়ার কোনো লক্ষণ নেই বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
"বাস্তবে বেশিরভাগ গুরুতর অপরাধের হার কমছে বা একই পর্যায়ে রয়েছে। তবে কিছু নির্দিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রে সামান্য বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা গেছে," বিবৃতিতে বলা হয়।
পরিস্থিতি আসলে কেমন
গত বছর আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে পুলিশি ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলো। পুলিশের বহু সদস্যের ওপর হামলার পাশাপাশি অনেক কর্মকর্তারা নিজেরাও আর কর্মস্থলে ফেরত যাননি।
এমন পরিস্থিতির পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক সহিংসতা, দখল-চাঁদাবাজি ও লুটপাটসহ কিছু সুনির্দিষ্ট অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, যা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বিপন্ন করে তোলে।
বিশেষ করে মব বা দলবদ্ধ সহিংসতা, গণপিটুনি ও চাঁদাবাজি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে অন্তর্বর্তী সরকার সমালোচনার মুখে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে অপরাধ মোকাবিলায় সরকারের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার ব্যাপক অভিযোগ উঠেছিলো।
যদিও ডিআইজি রেজাউল করিম বলছেন, দেশের যেখানেই যা ঘটুক, "সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং এক্ষেত্রে কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না"।
"অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে," বলেছেন তিনি।
অবশ্য পুলিশ সদর দপ্তরের আইনশৃঙ্খলার যে পরিসংখ্যান তৈরি করে সেই হিসেবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছেন এবং এর মধ্যে জুন মাসে দেশে সর্বোচ্চ ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন।
এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে প্রতি মাসে খুনের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে।
এছাড়া এ সময়কালে সারা দেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৬টি। আর নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১১ হাজার ৮টি।
পুলিশের আরেকজন কর্মকর্তা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের নিজেকে গুছিয়ে তুলতে কিছুটা সময় লেগেছে। বিশেষ করে অনেক পুলিশ কর্মকর্তার পালিয়ে যাওয়া, অনেককে অপরাধমূলক ঘটনায় আটক করা হয়েছে এবং চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় থানায় হামলার নানা ঘটনা ঘটেছে।
তার মতে, এর মধ্যেও সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারে সারা দেশে অভিযান চালানো হয়েছে।
এরপর আটই ফেব্রুয়ারি থেকে 'ডেভিল হান্ট' নামে আরেকটি বিশেষ অভিযানও শুরু হয়। যদিও এই অভিযান কতটা কাজে লেগেছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
কারণ এই অভিযানের মধ্যেও খুন, ডাকাতি, অপহরণ, মব সন্ত্রাস, ছিনতাই ও নারী শিশু নির্যাতনের মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানেই।
অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে অপরাধ বিষয়ে যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়, তাতে গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছর জুন পর্যন্ত মোট খুন হয়েছে তিন হাজার ৫৫৪ জন।
এছাড়া এই সময়কালে ডাকাতি হয়েছে ৬১০, দস্যুতা এক হাজার ৫২৬, দাঙ্গা ৯৭, ধর্ষণ চার হাজার ১০৫, নারী ও শিশু নির্যাতন ১২ হাজার ৭২৬ এবং পুলিশের আক্রান্ত হওয়ার ৪৭৯টি ঘটনা ঘটেছে।
এই হিসেবে গত বছর সেপ্টেম্বরে ৫৮৩ জন খুনের তথ্য দেওয়া হয়েছে। এরপর সেটি কয়েকমাস ধারাবাহিকভাবে কমেছিলো। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২৯৪ জন খুন হয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে খুনের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০০, মার্চে ৩১৬, এপ্রিলে ৩৩৬ এবং মে মাসে ৩৪১ জন খুন হন।
জুনে চলতি বছরের সর্বোচ্চ খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ মাসে সারা দেশে মোট ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন।
মানবাধিকার সংস্থা – মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন মে মাসে ৫৫টি এবং জুন মাসে ৪৯টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের তথ্য দিয়ে বলেছিলো, বেশিরভাগ ঘটনাতেই এসব লাশের পরিচয় অজ্ঞাত থেকে যাচ্ছে।
সংস্থাটির মতে, এটি নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ।
মব সন্ত্রাস ও গণপিটুনি
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আটই অগাস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরের কয়েক মাস ধরে বারবার আলোচনায় এসেছে মব বা দলবদ্ধ সহিংসতা এবং গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা।
প্রকাশ্য দিবালোকে কখনো কখনো সামাজিক মাধ্যমে পূর্বঘোষণা দিয়ে মব হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এমনকি ঢাকায় সংবাদপত্র কার্যালয়ের সামনেও ঘোষণা দিয়ে মব তৈরির চেষ্টা হয়েছে, যাতে সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ১৪১টি মবের ঘটনায় ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৩০টি, যার মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৬৬টি। এর মধ্যে ২২টি হলো ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা।
এই সময়ে গণপিটুনিতে ৮৯ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ঢাকাতেই মারা গেছে ৪৫ জন।
এছাড়া এই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছে ৪৪ জন। এসব সহিংসতার মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সহিংসতার ১৩১টি ঘটনায় মারা গেছে ২৬ জন, আর আহত হয়েছে ১৪৭৭ জন।
অন্যদিকে এই সময়কালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নিরাপত্তা হেফাজতে প্রাণ হারিয়েছে ১৫ জন।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি নামের একটি সংগঠন সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে , ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু, গণপিটুনিতে নির্যাতন ও হত্যা, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে।
আলোচিত যত ঘটনা
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানে সাবেক এক এমপির বাসায় সমন্বয়ক পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনা আলোচনায় উঠে আসে। পুলিশ এ ঘটনায় শেখ হাসিনা সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজনসহ কয়েকজনকে আটক করে।
এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনার মুখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া সব কমিটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে সক্রিয় থাকা কারও কারও বিরুদ্ধেই গত বছর অগাস্টের পর থেকেই ক্ষমতা প্রদর্শন, চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা আদায়, সচিবালয়ে তদবিরসহ নানা অভিযোগ আসলেও এগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ প্রকট হয়ে উঠছিলো।
মূলত, গুলশানের ঘটনাতেই প্রথম এ ধরনের অভিযোগে শক্ত ব্যবস্থা নিলো পুলিশ।
এর আগে ঢাকার ধানমন্ডির একটি বাড়িতে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে লোকজন নিয়ে হামলার পর আটককৃতদের থানা থেকে ছাড়িয়ে এনে আলোচনায় এসেছিলেন এনসিপির আরেকজন নেতা আব্দুল হান্নান মাসুদ। তাকেও গত মে মাসে ওই ঘটনার পর দল থেকে শোকজ করা হয়েছিলো।
তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পেয়েছিলো ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও পাথর দিয়ে আঘাত করে নৃশংস খুনের ঘটনায়।
এই ঘটনায় পাঁচ জনকে গ্রেফতারের কথা জানায় সরকার। এছাড়া মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের কথা জানিয়েছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
ওই হত্যাকাণ্ডের ঠিক দুইদিন পর ১১ই জুলাই খুলনা দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এর আগে ঢাকার কাছে মাদারীপুরে মসজিদে আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলো।
এসব আলোচিত ঘটনা ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে চাপাতি নিয়ে মানুষকে আক্রমণ, ছিনতাই ও হামলার অনেকগুলো ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার ঝড় তোলে।
সারাদেশে বেশ কিছু রাজনৈতিক প্রতিশোধের ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেকের বিরুদ্ধে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়মিতই এসেছে।
বিএনপি এ ধরনের অপরাধমূলক ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আসার পর তাদের প্রায় চার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
পুলিশের সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলছেন, নিরাপত্তাহীনতার বোধটা থেকেই গেছে এবং পুলিশ বা কর্তৃপক্ষের প্রতি যে ভয় থাকে সেটি চলে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে অনেকে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটালেও সেখানে হার্ড অ্যাকশন নেওয়া হয়নি।
"সমাজে অপরাধ সবসময় বাড়ে। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। তারপরেও অনেক ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুলিশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও ঠিকমতো কাজ করেনি। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা গেছে। সে কারণে অনেকে হয়তো সক্রিয় হয়নি। এসব কিছুর প্রভাবেই নিরাপত্তাহীনতার বোধ (সেন্স অফ ইনসিকিউরিটি) তৈরি হয়েছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আর পরিস্থিতি এই পর্যায়ে আসার ক্ষেত্রে পুলিশেকে পরিপূর্ণ সক্রিয় করতে না পারাটাকেই দায়ী করেন মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন।
"দীর্ঘকাল পুলিশ রাজনৈতিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার আওয়ামী লীগের পতনের পর পুলিশের ওপর নির্মম হামলা হয়েছে। সবমিলিয়ে পুলিশ মনোবল হারিয়েছে। এখন পুলিশকে সক্রিয় করতে হলে ছাত্র হত্যার মতো পুলিশ হত্যারও বিচার করতে হবে। তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে," বলছিলেন তিনি।
আবার কেউ কেউ মনে করেন আইনশৃঙ্খলার সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়াও দেশের সার্বিক রাজনীতি ও নির্বাচনেরও একটা সম্পর্ক আছে।
কোনো কোনো ঘটনা পুলিশ বা কর্তৃপক্ষ মৌন অবস্থান নিয়ে ঘটনাকে উসকে দিয়েছে-এমন অভিযোগও আছে।
"সরকার দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে সহযোগিতা আদায় করতে পারেনি। আবার নির্বাচনের সাথে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জড়িত। নির্বাচন পেছাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে অস্থিরতা তৈরির অভিযোগও আলোচনায় আছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সমাজ অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক।
তার মতে, আইন প্রয়োগকারী বাহিনীগুলো অনেক ঘটনাতেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, আবার অনেক সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হয়নি।
"পুলিশ বিবৃতি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে কিছু ঘটনায়। কিন্তু পুলিশের কাজ তো বিবৃতি দেওয়া নয়, বরং ব্যবস্থা নেওয়া। আবার কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে পুলিশও নিরাপত্তা সংকটে পড়েছে। যেসব পুলিশ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছে তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যথাযথ সমর্থন পাননি। সব মিলিয়েই আইনশৃঙ্খলার বর্তমান ঘাটতির পরিস্থিতি তৈরি করেছে," বলছিলেন মি. হক
বাংলাদেশে গত বছর অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এক বছর পার হলেও অপরাধ কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি সরকার। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো কেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না- সেই প্রশ্ন গত কিছুদিন ধরেই আলোচনায় আসছে।
সম্প্রতি সমালোচনার মুখে সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে দাবি করা হয়েছে যে 'চলতি বছর বড় ধরনের অপরাধের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য বেড়েছে-এই দাবি সঠিক নয়। এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা স্থিতিশীল আছে'।
পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা অবশ্য বিবিসির কাছে স্বীকার করেছেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রায় ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনীকে পুরোপুরি সক্ষম করে তোলার জন্য তারা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এমনকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে 'ডেভিল হান্ট' কিংবা 'চিরুনি অভিযানের' মতো কর্মসূচির কথা সরকার বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হলেও সেগুলো কতটা কাজে এসেছে তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
অথচ গত এক বছর ধরেই দেশজুড়ে সেনাবাহিনীও মোতায়েন রাখা হয়েছে।
তবে এতদিন 'মব' সন্ত্রাস বা কিছু লোক জড়ো হয়ে হামলা বা চাঁদাবাজির মতো ঘটনাগুলো নিয়ে এক ধরনের 'দেখেও এড়িয়ে' যাওয়ার অভিযোগ ছিল। সম্প্রতি গুলশানে একজন সাবেক এমপির বাড়ি থেকে সমন্বয়ক পরিচয় চাঁদা আদায়ের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের ঘটনাকে এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে 'প্রথমবারের মতো পুলিশের কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ' হিসেবে অনেকে বিবেচনা করছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারা, কিছু ঘটনায় কর্তৃপক্ষের মৌন থাকা, আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর প্রতি ভয় কমে যাওয়া এবং বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশের মধ্যেই আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরি হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যায়নি।
তবে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশনস) মো. রেজাউল করিম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে পুলিশ এখন সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করছে এবং এর ফলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়ে এসেছে।
"অপরাধমূলক কোনো ঘটনাই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না–– এটি নিশ্চিত করা হচ্ছে। কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মানবাধিকার সমুন্নত রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে যা যা করণীয় সেটিই এখন করা হচ্ছে," বলছিলেন তিনি।
সহিংস অপরাধের সংখ্যা বাড়েনি: প্রেস উইং
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গত ১৪ই জুলাই এক বিবৃতিতে বলেছে, চলতি বছর দেশে অপরাধের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে—বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবরে জনমনে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে।
"২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সরকারি অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছর বড় ধরনের অপরাধের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে—এমন দাবি সঠিক নয়"।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ মাসে বড় ধরনের অপরাধের প্রবণতা স্থিতিশীল রয়েছে। পরিসংখ্যানে বড় ধরনের অপরাধ দ্রুত বাড়ার কোনো লক্ষণ নেই বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
"বাস্তবে বেশিরভাগ গুরুতর অপরাধের হার কমছে বা একই পর্যায়ে রয়েছে। তবে কিছু নির্দিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রে সামান্য বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা গেছে," বিবৃতিতে বলা হয়।
পরিস্থিতি আসলে কেমন
গত বছর আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে পুলিশি ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলো। পুলিশের বহু সদস্যের ওপর হামলার পাশাপাশি অনেক কর্মকর্তারা নিজেরাও আর কর্মস্থলে ফেরত যাননি।
এমন পরিস্থিতির পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক সহিংসতা, দখল-চাঁদাবাজি ও লুটপাটসহ কিছু সুনির্দিষ্ট অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, যা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বিপন্ন করে তোলে।
বিশেষ করে মব বা দলবদ্ধ সহিংসতা, গণপিটুনি ও চাঁদাবাজি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে অন্তর্বর্তী সরকার সমালোচনার মুখে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে অপরাধ মোকাবিলায় সরকারের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার ব্যাপক অভিযোগ উঠেছিলো।
যদিও ডিআইজি রেজাউল করিম বলছেন, দেশের যেখানেই যা ঘটুক, "সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং এক্ষেত্রে কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না"।
"অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে," বলেছেন তিনি।
অবশ্য পুলিশ সদর দপ্তরের আইনশৃঙ্খলার যে পরিসংখ্যান তৈরি করে সেই হিসেবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছেন এবং এর মধ্যে জুন মাসে দেশে সর্বোচ্চ ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন।
এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে প্রতি মাসে খুনের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে।
এছাড়া এ সময়কালে সারা দেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৬টি। আর নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১১ হাজার ৮টি।
পুলিশের আরেকজন কর্মকর্তা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের নিজেকে গুছিয়ে তুলতে কিছুটা সময় লেগেছে। বিশেষ করে অনেক পুলিশ কর্মকর্তার পালিয়ে যাওয়া, অনেককে অপরাধমূলক ঘটনায় আটক করা হয়েছে এবং চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় থানায় হামলার নানা ঘটনা ঘটেছে।
তার মতে, এর মধ্যেও সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারে সারা দেশে অভিযান চালানো হয়েছে।
এরপর আটই ফেব্রুয়ারি থেকে 'ডেভিল হান্ট' নামে আরেকটি বিশেষ অভিযানও শুরু হয়। যদিও এই অভিযান কতটা কাজে লেগেছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
কারণ এই অভিযানের মধ্যেও খুন, ডাকাতি, অপহরণ, মব সন্ত্রাস, ছিনতাই ও নারী শিশু নির্যাতনের মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানেই।
অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে অপরাধ বিষয়ে যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়, তাতে গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছর জুন পর্যন্ত মোট খুন হয়েছে তিন হাজার ৫৫৪ জন।
এছাড়া এই সময়কালে ডাকাতি হয়েছে ৬১০, দস্যুতা এক হাজার ৫২৬, দাঙ্গা ৯৭, ধর্ষণ চার হাজার ১০৫, নারী ও শিশু নির্যাতন ১২ হাজার ৭২৬ এবং পুলিশের আক্রান্ত হওয়ার ৪৭৯টি ঘটনা ঘটেছে।
এই হিসেবে গত বছর সেপ্টেম্বরে ৫৮৩ জন খুনের তথ্য দেওয়া হয়েছে। এরপর সেটি কয়েকমাস ধারাবাহিকভাবে কমেছিলো। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২৯৪ জন খুন হয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে খুনের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০০, মার্চে ৩১৬, এপ্রিলে ৩৩৬ এবং মে মাসে ৩৪১ জন খুন হন।
জুনে চলতি বছরের সর্বোচ্চ খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ মাসে সারা দেশে মোট ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন।
মানবাধিকার সংস্থা – মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন মে মাসে ৫৫টি এবং জুন মাসে ৪৯টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের তথ্য দিয়ে বলেছিলো, বেশিরভাগ ঘটনাতেই এসব লাশের পরিচয় অজ্ঞাত থেকে যাচ্ছে।
সংস্থাটির মতে, এটি নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ।
মব সন্ত্রাস ও গণপিটুনি
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আটই অগাস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরের কয়েক মাস ধরে বারবার আলোচনায় এসেছে মব বা দলবদ্ধ সহিংসতা এবং গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা।
প্রকাশ্য দিবালোকে কখনো কখনো সামাজিক মাধ্যমে পূর্বঘোষণা দিয়ে মব হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এমনকি ঢাকায় সংবাদপত্র কার্যালয়ের সামনেও ঘোষণা দিয়ে মব তৈরির চেষ্টা হয়েছে, যাতে সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ১৪১টি মবের ঘটনায় ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৩০টি, যার মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৬৬টি। এর মধ্যে ২২টি হলো ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা।
এই সময়ে গণপিটুনিতে ৮৯ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ঢাকাতেই মারা গেছে ৪৫ জন।
এছাড়া এই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছে ৪৪ জন। এসব সহিংসতার মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সহিংসতার ১৩১টি ঘটনায় মারা গেছে ২৬ জন, আর আহত হয়েছে ১৪৭৭ জন।
অন্যদিকে এই সময়কালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নিরাপত্তা হেফাজতে প্রাণ হারিয়েছে ১৫ জন।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি নামের একটি সংগঠন সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে , ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু, গণপিটুনিতে নির্যাতন ও হত্যা, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে।
আলোচিত যত ঘটনা
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানে সাবেক এক এমপির বাসায় সমন্বয়ক পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনা আলোচনায় উঠে আসে। পুলিশ এ ঘটনায় শেখ হাসিনা সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজনসহ কয়েকজনকে আটক করে।
এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনার মুখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া সব কমিটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে সক্রিয় থাকা কারও কারও বিরুদ্ধেই গত বছর অগাস্টের পর থেকেই ক্ষমতা প্রদর্শন, চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা আদায়, সচিবালয়ে তদবিরসহ নানা অভিযোগ আসলেও এগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ প্রকট হয়ে উঠছিলো।
মূলত, গুলশানের ঘটনাতেই প্রথম এ ধরনের অভিযোগে শক্ত ব্যবস্থা নিলো পুলিশ।
এর আগে ঢাকার ধানমন্ডির একটি বাড়িতে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে লোকজন নিয়ে হামলার পর আটককৃতদের থানা থেকে ছাড়িয়ে এনে আলোচনায় এসেছিলেন এনসিপির আরেকজন নেতা আব্দুল হান্নান মাসুদ। তাকেও গত মে মাসে ওই ঘটনার পর দল থেকে শোকজ করা হয়েছিলো।
তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পেয়েছিলো ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও পাথর দিয়ে আঘাত করে নৃশংস খুনের ঘটনায়।
এই ঘটনায় পাঁচ জনকে গ্রেফতারের কথা জানায় সরকার। এছাড়া মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের কথা জানিয়েছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
ওই হত্যাকাণ্ডের ঠিক দুইদিন পর ১১ই জুলাই খুলনা দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এর আগে ঢাকার কাছে মাদারীপুরে মসজিদে আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলো।
এসব আলোচিত ঘটনা ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে চাপাতি নিয়ে মানুষকে আক্রমণ, ছিনতাই ও হামলার অনেকগুলো ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার ঝড় তোলে।
সারাদেশে বেশ কিছু রাজনৈতিক প্রতিশোধের ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেকের বিরুদ্ধে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়মিতই এসেছে।
বিএনপি এ ধরনের অপরাধমূলক ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আসার পর তাদের প্রায় চার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
পুলিশের সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলছেন, নিরাপত্তাহীনতার বোধটা থেকেই গেছে এবং পুলিশ বা কর্তৃপক্ষের প্রতি যে ভয় থাকে সেটি চলে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে অনেকে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটালেও সেখানে হার্ড অ্যাকশন নেওয়া হয়নি।
"সমাজে অপরাধ সবসময় বাড়ে। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। তারপরেও অনেক ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুলিশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও ঠিকমতো কাজ করেনি। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা গেছে। সে কারণে অনেকে হয়তো সক্রিয় হয়নি। এসব কিছুর প্রভাবেই নিরাপত্তাহীনতার বোধ (সেন্স অফ ইনসিকিউরিটি) তৈরি হয়েছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আর পরিস্থিতি এই পর্যায়ে আসার ক্ষেত্রে পুলিশেকে পরিপূর্ণ সক্রিয় করতে না পারাটাকেই দায়ী করেন মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন।
"দীর্ঘকাল পুলিশ রাজনৈতিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার আওয়ামী লীগের পতনের পর পুলিশের ওপর নির্মম হামলা হয়েছে। সবমিলিয়ে পুলিশ মনোবল হারিয়েছে। এখন পুলিশকে সক্রিয় করতে হলে ছাত্র হত্যার মতো পুলিশ হত্যারও বিচার করতে হবে। তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে," বলছিলেন তিনি।
আবার কেউ কেউ মনে করেন আইনশৃঙ্খলার সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়াও দেশের সার্বিক রাজনীতি ও নির্বাচনেরও একটা সম্পর্ক আছে।
কোনো কোনো ঘটনা পুলিশ বা কর্তৃপক্ষ মৌন অবস্থান নিয়ে ঘটনাকে উসকে দিয়েছে-এমন অভিযোগও আছে।
"সরকার দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে সহযোগিতা আদায় করতে পারেনি। আবার নির্বাচনের সাথে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জড়িত। নির্বাচন পেছাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে অস্থিরতা তৈরির অভিযোগও আলোচনায় আছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সমাজ অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক।
তার মতে, আইন প্রয়োগকারী বাহিনীগুলো অনেক ঘটনাতেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, আবার অনেক সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হয়নি।
"পুলিশ বিবৃতি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে কিছু ঘটনায়। কিন্তু পুলিশের কাজ তো বিবৃতি দেওয়া নয়, বরং ব্যবস্থা নেওয়া। আবার কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে পুলিশও নিরাপত্তা সংকটে পড়েছে। যেসব পুলিশ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছে তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যথাযথ সমর্থন পাননি। সব মিলিয়েই আইনশৃঙ্খলার বর্তমান ঘাটতির পরিস্থিতি তৈরি করেছে," বলছিলেন মি. হক
এর আগে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন জোট সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া ৮৫ জন কর্মকর্তাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেয়ার অভিযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর চাকরিচ্যুত করা হয়।
১৩ ঘণ্টা আগেআবহাওয়া অফিস জানায়, উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশ ও দক্ষিণ ওড়িষ্যার উপকূলের অদূরে পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়ে পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশ-দক্ষিণ ওড়িষ্যার উপকূল এলাকায় অবস্থান করছে
১৪ ঘণ্টা আগেএতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭০ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬৬ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩১ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭৪ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোর
১৪ ঘণ্টা আগে