সাহিত্য
ফুড কনফারেন্স: এক রাজনৈতিক প্রহসনের সহজ পাঠ

বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক ব্যঙ্গ বা পলিটিক্যাল স্যাটায়ারের এক অনন্য নাম আবুল মনসুর আহমেদ। তাঁর লেখায় যেমন হাসির খোরাক আছে, তেমনই আছে গভীর চিন্তার খোরাক। যেসব গল্পে আমরা হেসে উঠি, সেগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকে সমাজের নির্মম বাস্তবতা, দুর্নীতি আর নৈতিকতার অবক্ষয়। তাঁর 'ফুড কনফারেন্স' বইটি হলো এমনই একটি সৃষ্টি, যেখানে রসের ভেতরে গেঁথে আছে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের কাঁটা।
এই বইয়ের গল্পগুলো একদিকে যেমন রম্যরচনা, অন্যদিকে তেমনি গভীর রাজনৈতিক ব্যাখ্যা। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সেই সময়ের শাসকদের ব্যর্থতা, উদাসীনতা, দুর্নীতি আর অসততা—সব কিছুই মিশে আছে এই গ্রন্থে। তবে কঠিন ভাষায় নয়, লেখক এগুলো বলেছেন এমন সহজ-সরল ভাষায়, যা সাধারণ পাঠকও অনায়াসে বুঝতে পারেন।
'ফুড কনফারেন্স' বইটি নয়টি ছোটগল্পের একটি সংকলন—প্রতিটি গল্পের পেছনেই রয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা। এবার আমরা একে একে প্রতিটি গল্প নিয়ে আলোচনা করব, সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করব তার মর্মার্থ ও তাৎপর্য।
ফুড কনফারেন্স : এই গল্পের পটভূমি হলো ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ। বাংলার গ্রামে গ্রামে মানুষ খেতে না পেয়ে মরছে, অথচ রাজধানীতে চলছে খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলার নামে কনফারেন্স, বক্তৃতা আর ভোজনের উৎসব।
গল্পের চরিত্রগুলোর নাম যেমন—শেরে বাংলা, মহিষে বাংলা, কুত্তায় বাংলা, ছাগলে বাংলা—সবই প্রতীকী। এরা মানুষ নয়, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিচ্ছবি। শেরে বাংলা হচ্ছেন রাজনীতিক; মহিষে বাংলা হচ্ছেন আমলা; কুত্তায় বাংলা নিরাপত্তারক্ষী বা বাহিনী; আর ছাগলে বাংলা সাধারণ জনগণ।
এই কনফারেন্সে নানা বক্তৃতা হয়, পরিকল্পনা হয়, কিন্তু দুর্ভিক্ষের সমাধান হয় না। মানুষ মরে যাচ্ছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত হচ্ছে কিভাবে সভায় আরও উন্নত খাবার পরিবেশন করা যায়। শেষপর্যন্ত, সবাই মারা যায় কেবল জানোয়ার ছাড়া। ছাগলে বাংলা বলেন, "মানুষে বাংলা সব মরে গেল, আর কেবল জানোয়ারে বাংলা বেঁচে রইল।"
এই গল্প দেখাে, সমাজে সমস্যা সমাধানের বদলে কেবল কথা আর খাওয়া চলে, সেখানে মানুষ টেকে না, টেকে কেবল পশুরা।
সায়েন্টিফিক বিজনেস : এই গল্পে দেখা যায়, দুই বন্ধু আজিজ ও নরেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উপদেশে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যবসা শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির উন্নয়ন। কিন্তু ব্যবসা শুরুর পর তারা ধীরে ধীরে অসততার পথে হাঁটে। মাড়োয়ারি বন্ধু তাদের সততার অভাব দেখে সরে যান।
তারা গঠন করে 'নিখিলবঙ্গ বণিক সংঘ' এবং ব্যবসার নামে নানা প্রতারণা শুরু করে। এতটাই চাতুর্যে তারা ব্যবসা চালায় যে, একসময় এই অসততা ছড়িয়ে পড়ে গোটা জাতিতে। এমনকি মৃত্যুর পরও তাদের দুর্নীতির প্রভাব পৌঁছে যায় স্বর্গ-নরকে। অবশেষে স্রষ্টা তাদের জাতিসুদ্ধ ধ্বংস করে দেন।
এই গল্পে লেখক ব্যঙ্গ করে দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র বাঙালি বলে কেউ ভালো ব্যবসায়ী হয় না, যদি তার মন-মানসিকতা অসৎ হয়। ব্যাবসায় সততা না থাকলে জাতি হিসেবে বাঁচা যায় না।
রিলিফ ওয়ার্ক: গল্পের নায়ক হামিদ একজন অফিস কর্মচারী। বন্যায় আক্রান্ত মানুষ দেখে তার মন কাঁদে। সে স্বেচ্ছায় রিলিফ কাজে অংশ নেয়। প্রথমে সে ভাবে সে মহৎ কিছু করছে। কিন্তু পরে দেখতে পায়, রিলিফ কাজের নামে চলছে বড় রকমের দুর্নীতি।
যারা ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য, তারা পায় না। যারা বিত্তবান, তারা চাল-ডাল পাচ্ছে বস্তাভরে। হামিদ প্রতিবাদ করে, কিন্তু কারও টনক নড়ে না। সে দেখে, অনাহারে থাকা মানুষগুলো একদিন গোডাউনে হানা দেয় চালের বস্তা চুরি করতে। পুলিশ এসে তাদের ধরে নিয়ে যায়, শাস্তি দেয়। হতাশ হয়ে হামিদ চাকরিতে ফিরে আসে।
এই গল্পে লেখক দেখিয়েছেন—ভালো মানুষ চাইলেও এই সিস্টেমের মধ্যে ভালো কিছু করতে পারে না। মানবসেবার নামে অনেক সময় চলে লোক দেখানো কাজ আর সুবিধা লোটার প্রতিযোগিতা।
গ্রো মোর ফুড: এই গল্পের রাজা হলেন হবুচন্দ্র, আর মন্ত্রী গবুচন্দ্র। তারা সিদ্ধান্ত নেন খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। তারা নানা পাগলামি সিদ্ধান্ত নেয়—ধানের জায়গায় গাঁজা চাষ, শাকসবজি উৎপাদনের বদলে নানা ভেলকিবাজি।
খাদ্য উৎপাদন না বেড়ে বরং বিপদ আরও বাড়ে। কিন্তু রাজা-মন্ত্রী তাতেও থেমে থাকেন না, তারা নতুন নতুন 'নির্দেশনা' দিয়ে চলেন। দেশ খাদ্যশূন্য হয়ে পড়ে।
এই গল্পে লেখক প্রশাসনিক গাফিলতি ও বাস্তবতাবিবর্জিত নীতির ব্যঙ্গচিত্র তুলে ধরেছেন। আজকের দিনের উন্নয়ন প্রকল্পেও মাঝে মাঝে এমন উদ্ভট সিদ্ধান্ত দেখা যায়।
জমিদারি উচ্ছেদ : গল্পের চরিত্র মুন্সি সাহেব। তিনি জমিদার উচ্ছেদের নামে আন্দোলন করেন, বক্তৃতা দেন, লেখালেখি করেন। কিন্তু পরে জানা যায়, তিনিই গোপনে জমি কিনে নিচ্ছেন। জমিদারি উঠিয়ে দিয়ে নিজেই হয়ে যান জমিদার।
এই গল্পে লেখক দেখিয়েছেন—আদর্শের মুখোশ পরে যারা নিজের স্বার্থ হাসিল করে, তারা সমাজের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রতারক। বাস্তবেও আমরা এমন অনেক আন্দোলনকারী দেখি, যারা শেষপর্যন্ত নিজেই ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে যান।
জনসেবা ইউনিভার্সিটি : ইয়াকুব সাহেব প্রতিষ্ঠা করেন 'জনসেবা ইউনিভার্সিটি'। উদ্দেশ্য—গরিব মানুষের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা দেয়া। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে হলে দিতে হয় বড় অঙ্কের ঘুষ। আর যাদের টাকা আছে, তারাই ভর্তি হতে পারে। শিক্ষার বদলে চলে বক্তৃতা, বাণী আর অনুষ্ঠান।
পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক হন লর্ড জ্যাকব নামের একজন ধনী লোক, যার কাজই হলো সবকিছুকে পণ্য বানিয়ে ফেলা।
এই গল্পের মাধ্যমে লেখক আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অসারতা ও বাণিজ্যিকীকরণের কড়া সমালোচনা করেছেন। আজকের দিনে এই গল্প আরও বেশি বাস্তব বলে মনে হয়।
লঙ্গরখানা: এই গল্পে এক ধনী ব্যক্তি চালু করেন লঙ্গরখানা—অর্থাৎ গরিবদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থার জায়গা। কিন্তু সেখানে এমন নিয়ম চালু হয়, যাতে গরিবদের অপমান করা হয়। তাদের লাইনে দাঁড়াতে হয়, ছোট্ট কাপের মধ্যে আধভর্তি খিচুড়ি দেওয়া হয়।
গল্পের এক পর্যায়ে দেখা যায়, দানের নামে সেই ধনী ব্যক্তি নিজের প্রচার চালান, সংবাদপত্রে ছবি ছাপান, পুরস্কার পান। গরিব মানুষরা এখানে হয়ে পড়ে শুধু তার পদলেহনকারী।
এম.এ. সি.এস.পি: এই গল্পের নায়ক একজন উচ্চশিক্ষিত লোক, যিনি পাশ করেছেন এম.এ., সি.এস.পি। তার লক্ষ্য সমাজসেবা নয়, চাকরি পাওয়া আর নিজের আখের গোছানো। সে নানা পদের জন্য আবেদন করে, সবখানেই নিজেকে বড় বড় পদে মানানসই মনে করে।
শেষে দেখা যায়, সে এমন জায়গায় চাকরি পায় যেখানে কোনো কাজই নেই—কেবল বসে থাকা আর বেতন তোলা। আরেকদিকে, গরিব যুবক কাজের খোঁজে খোঁজে হন্যে হয়।
এই গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, সমাজে শিক্ষার মান যদি শুধু সার্টিফিকেট হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কর্মসংস্থান হয় না, হয় আত্মসন্তুষ্টি।
সৎ নাগরিক: এই গল্পে মূল চরিত্র একজন 'সৎ নাগরিক'। সে নিয়ম মেনে চলে, ঘুষ খায় না, মিথ্যা বলে না। কিন্তু তার এই সততা তাকে একের পর এক সমস্যায় ফেলে দেয়। পুলিশ তাকে সন্দেহ করে, অফিস তাকে অবিশ্বাস করে, প্রতিবেশীরা তাকে এড়িয়ে চলে।
শেষে সে একদিন আত্মহত্যা করে—কারণ এই সমাজে সৎ থাকাটা তার জন্য হয়ে যায় অসহনীয়।
এই গল্প আমাদের ভয়ানক বাস্তবতা দেখায়—সৎ থাকতে চাইলেও সমাজের নানা অব্যবস্থা সেটা হতে দেয় না। আজকের সমাজেও এমন বহু উদাহরণ আছে।
ব্যঙ্গের মধ্যে লুকানো সত্য
‘ফুড কনফারেন্স’ বইটি শুধু হাসির গল্প ভরপুর নয়, এটা আমাদের সমাজ, রাজনীতি আর মনুষ্যত্বের আয়না। আবুল মনসুর আহমেদ এই বইয়ের মাধ্যমে যা বলেছেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি দেখিয়েছেন—যেখানে অন্যায় চলে, সেখানে প্রতিবাদ করাও একধরনের দায়িত্ব।
প্রতিটি গল্প দেখায়—হাসির ভেতরে লুকিয়ে থাকে কান্নার গভীরতা। আর সেই কান্না বুঝতে পারলেই আমরা বুঝতে পারি, কেন এই গল্পগুলো যুগে যুগে এত প্রাসঙ্গিক। ‘ফুড কনফারেন্স’ তাই শুধু একটি বই নয়, একটি দর্শন, একটি সামাজিক পাঠ, একটি রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ।