রাজনীতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল?

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০২৫, ১২: ০২

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্ররাজনীতি একসময় ছিল জাতীয় রাজনীতির প্রাণশক্তি, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। আশির দশকে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নতুন করে সক্রিয় হয় ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনটি মূলত জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন হিসেবে কাজ করত এবং তাদের কার্যক্রম দ্রুতই ঢাবি ক্যাম্পাসে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনের সময় ছাত্রশিবিরের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো যখন সর্বাত্মকভাবে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিল, তখন শিবির অনেক ক্ষেত্রে সরকারপন্থী অবস্থান নিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এর পাশাপাশি ক্যাম্পাসে সহিংসতার ঘটনা এবং কিছু হত্যাকাণ্ড ছাত্রশিবিরকে আরও বিতর্কিত করে তোলে। বিশেষ করে ১৯৮৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল নেতাকে হত্যার ঘটনায় শিবিরের নাম সামনে আসে। এ ঘটনার পর শিক্ষাঙ্গনের মধ্যে ছাত্রশিবিরকে ঘিরে প্রবল ক্ষোভ জন্ম নেয়।

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান স্বৈরশাসকের পতন ঘটাতে শিক্ষার্থীরা একটা বড় ভূমিকা রাখে। তখন ঢাবি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একমত হন যে ছাত্ররাজনীতির সহিংস ধারা আর মেনে নেওয়া যাবে না। তাই গণআন্দোলন পরবর্তী সময়, অর্থাৎ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরকে কার্যত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আনুষ্ঠানিক লিখিত কোনো নোটিশ বা অধ্যাদেশ প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ক্যাম্পাসে শিবিরের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঢাবির ইতিহাসে এটি এক ধরনের অলিখিত আইন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ, ছাত্রশিবির চাইলে ঢাবি ক্যাম্পাসে সক্রিয় থাকতে পারত না, কারণ পুরো ক্যাম্পাসই তাদের কার্যক্রম প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ ছিল।

এই নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ ছিল সহিংস রাজনীতি এবং শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হওয়া। আশির দশকের শেষভাগে ছাত্র শিবিরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একাধিক দাঙ্গা, সংঘর্ষ ও টর্চার সেলের মাধ্যমে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের জোর করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার প্রবণতা, বিরোধীদের ওপর হামলা, এমনকি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ক্যাম্পাসে আতঙ্ক ছড়ায়। তাই শিক্ষার্থীরা মনে করেছিল যে এই সংগঠনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরে রাখা ছাড়া শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নরব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ঢাবি থেকে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি বন্ধ হয়। ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে সহিংসতা যখন চরমে পৌঁছে গিয়েছিল, তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা আর সেটি সহ্য করেনি। তাই শিক্ষক ও ছাত্ররা একত্রে শিবিরের কার্যক্রম ঠেকিয়ে দিয়েছিল। এটি ছিল এক ধরনের সামাজিক চুক্তি, যা লিখিত না হলেও কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল।

বিদেশি গবেষকরাও বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করেছেন। আমেরিকান রাজনৈতিক বিশ্লেষক চার্লস টি. কল, যিনি দক্ষিণ এশিয়ার ছাত্ররাজনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন, তিনি বলেন—“বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একদিকে গণতন্ত্রের জন্য পাঠশালা, আবার অন্যদিকে সহিংসতার ক্ষেত্র। যখন কোনো সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রতিরোধ আসে।” তাঁর মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে মূল যুক্তি ছিল নিরাপত্তা এবং শিক্ষা-পরিবেশ রক্ষা।

ব্রিটিশ গবেষক ডেভিড লুইস বাংলাদেশে এনজিও ও রাজনীতি নিয়ে বহু কাজ করেছেন, তিনি বিষয়টিকে সামাজিক স্থিতিশীলতার দিক থেকে দেখেছেন। তাঁর মতে, “ঢাবি বাংলাদেশের প্রতীকী জায়গা। এখানে যদি সহিংস রাজনীতি প্রভাব বিস্তার করে, তবে তা গোটা সমাজেই প্রতিফলিত হয়। তাই শিবিরকে ঢাবি থেকে সরিয়ে দেওয়া ছিল এক ধরনের সামাজিক প্রয়োজন।” তিনি আরও বলেন যে বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি অতীতে যেমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছে, তেমনি সহিংসতা ও দলীয় প্রভাবের কারণে বারবার সংকটে পড়েছে।

এই সিদ্ধান্ত যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল, তা নয়। কেউ কেউ মনে করেন যে ছাত্রশিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে তাড়ানো গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী। তাদের যুক্তি হলো, যদি অন্য দলগুলো থাকতে পারে, তবে একটি নির্দিষ্ট সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কেন? তবে ঢাবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যে পরিস্থিতি দেখেছেন, তা ছিল ভিন্ন। তাদের জন্য মূল বিষয় ছিল শিক্ষার পরিবেশ এবং নিরাপত্তা। তাই রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্নে নয়, বরং সহিংসতার কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি তাই শুধু রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, বরং সামাজিক শিক্ষারও একটি অধ্যায়। এটি দেখিয়েছে যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সমাজ যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তবে তারা নিজেদের পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। বিদেশি গবেষকদের মতে, এই অভিজ্ঞতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও একটি শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

শেষ দিনে ৪৪২-সহ ডাকসুর মনোনয়ন সংগ্রহ ৫৬৫ প্রার্থীর

ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক জসীম উদ্দিন বলেন, সপ্তম দিনে ডাকসুর বিভিন্ন পদে জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছে ৪৪২ জন। এখন পর্যন্ত সাত দিনে ডাকসুতে মোট মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ৫৬৫ জন এবং ১৮টি হল সংসদের জন্য মোট মনোনয়ন সংগ্রহ করেছে এক হাজার ২২৬ জন।

১৫ ঘণ্টা আগে

ব্যাটল অব হ্যাস্টিংসের ইতিহাস

ইংল্যান্ডের সিংহাসন তখন ছিল এক জটিল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্র। ইংরেজ রাজা এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর ১০৬৬ সালের জানুয়ারিতে উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল—কে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হবেন? রাজ্যের প্রধান অভিজাতেরা হ্যারল্ড গডউইনসনকে রাজা ঘোষণা করলেন।

১৫ ঘণ্টা আগে

ডাকসুতে শিবিরের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম, জিএস পদে ফরহাদ

ডাকসুকে ভিপি পদে প্রার্থী সাদিক কায়েম শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি। অন্যদিকে জিএস পদে প্রার্থী এস এম ফরহাদ শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বর্তমান সভাপতি।

১৭ ঘণ্টা আগে

ডাকসুতে শিবিরের প্যানেল ঘোষণা, নেতৃত্বে যারা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিবিরের সাবেক সভাপতি সাদেক কায়েমকে ভিপি ও বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদকে জিএস করে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা করেছে সংগঠনটি।

২০ ঘণ্টা আগে