বিশ্ব রাজনীতি

ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছিলেন আইনস্টাইন

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ১৮: ১৫
আইনস্টাইন মনে করতেন রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল টিকবে না। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আলবার্ট আইনস্টাইনকে বিজ্ঞানী হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু এই বিখ্যাত বিজ্ঞানী শুধু পদার্থবিদ্যার মধ্যেই ডুবে থাকতেন না, তিনি রাজনীতি, মানবতা আর শান্তির প্রশ্নেও ছিলেন অত্যন্ত সচেতন ও দায়িত্বশীল একজন মানুষ। এক সময় তিনি নিজেই বলেছিলেন, ইসরায়েল রাষ্ট্র একদিন পতনের দিকে এগোবে। আজ যখন ফিলিস্তিনে একের পর এক হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনায় ভেঙে পড়ছে ইসরায়েল, তখন আইনস্টাইনের সেই আশঙ্কা আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে।

আইনস্টাইন ছিলেন ইহুদি। নাৎসি জার্মানি থেকে পালিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ইহুদি পরিচয় নিয়েও তিনি ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি ইহুদি রাষ্ট্র তৈরি হলে সেটা জাতিগত ও ধর্মীয় আধিপত্যের দিকে নিয়ে যাবে, যা আবার নতুন ধরনের বর্ণবাদ, বিভাজন এবং সহিংসতার জন্ম দেবে।

রাজনীতি নয়, শান্তির পক্ষে ছিলেন তিনি

১৯৪৬ সালে আমেরিকান-ব্রিটিশ একটি অনুসন্ধান কমিটিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আইনস্টাইন স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘‘আমি মনে করি এটা (ইসরায়েল রাষ্ট্রের ধারণা) খারাপ।’’ সে সময় তিনি মনে করতেন, ইহুদিদের জন্য আলাদা কোনো রাষ্ট্র গঠনের বদলে সবার জন্য সমান অধিকারসম্পন্ন একটি সমাজ গঠন করাই উচিত।

১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হলো, তখন তার বিরোধিতায় আইনস্টাইন ও একদল ইহুদি বুদ্ধিজীবী নিউইয়র্ক টাইমসে একটি খোলা চিঠি লিখে প্রকাশ করেন। সেই চিঠিতে বলা হয়, তৎকালীন ইসরায়েলি রাজনীতিবিদ মেনাহেম বেগিনের দল ‘হেরুত’ আসলে নাৎসিদের মতোই একটি ফ্যাসিস্ট সংগঠন। অথচ সেই দলটিই পরবর্তীকালে রূপ নেয় আজকের শাসকদল লিকুদ পার্টিতে, যার নেতৃত্বে আছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

একটি চিঠি, একটি বার্তা

সবচেয়ে বিস্ময়কর ও শক্তিশালী আইনস্টাইন-প্রদত্ত বক্তব্য পাওয়া যায় ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে লেখা একটি সংক্ষিপ্ত চিঠিতে। সে সময় ফিলিস্তিনের দেইর ইয়াসিন গ্রামে ইহুদি সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুন এবং স্টার্ন গ্যাংয়ের হামলায় নিহত হয় শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু। তাদের ওপর চালানো হয় গুলি, গ্রেনেড বিস্ফোরণ, ধর্ষণ, অঙ্গচ্ছেদ—সবই। এক কথায়, এক ভয়াবহ গণহত্যা।

আইনস্টাইন এই চিঠি লেখেন শেফার্ড রিফকিনকে। ছবি: সংগৃহীত

এই ঘটনার মাত্র একদিন পরেই নিউইয়র্কে বসে আইনস্টাইন লিখলেন একটি চিঠি শেফার্ড রিফকিন নামে এক ব্যক্তিকে, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে স্টার্ন গ্যাংয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছিলেন। সেই চিঠিতে আইনস্টাইন স্পষ্ট ভাষায় লেখেন— ‘‘যখন ফিলিস্তিনে আমাদের ওপর কোনো সত্যিকারের ও চূড়ান্ত বিপর্যয় নেমে আসবে, তখন তার জন্য দায়ী হবে আমাদের নিজেদের গড়া সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। আমি এদের সঙ্গে থাকতে রাজি নই।”

এই বক্তব্য অনেক গবেষক এখনো উদ্ধৃত করেন আইনস্টাইনের সবচেয়ে শক্তিশালী ‘অ্যান্টি-জায়োনিস্ট’ বার্তা হিসেবে।

প্রেসিডেন্ট হতে রাজি হননি

আইনস্টাইনকে ১৯৫২ সালে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন নিজেই প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আইনস্টাইন বিনয়ের সঙ্গে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। কারণ, তিনি জানতেন একটি রাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকা মানে অস্ত্র, রাজনীতি আর শক্তির খেলা—যা তাঁর শান্তিবাদী মননের সঙ্গে একেবারেই যায় না। তিনি শান্তি ও জ্ঞানের প্রতীক হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনের নিজের নিরিবিলি ঘরেই ফিরে যান।

তবে সবসময় এমন ছিলেন না আইনস্টাইন। ১৯২৯ সালে তিনি ‘ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান’-এ লেখা একটি চিঠিতে ফিলিস্তিনে ইহুদি যুবকদের প্রশংসা করেছিলেন। তাঁদের কাজ ছিল সড়ক তৈরি, পরিত্যক্ত জমিকে আবাদে রূপান্তর, শিক্ষাব্যবস্থা গড়া—সব মিলিয়ে তিনি তাঁদেরকে নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে চমৎকার বলে উল্লেখ করেন।

এই ধারণা তাঁর মধ্যে গড়ে উঠেছিল ১৯২৩ সালের একমাত্র মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময়। সেবার তিনি ফিলিস্তিনে ১২ দিন কাটিয়েছিলেন এবং হিব্রু ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতাও দিয়েছিলেন।

ইসরায়েল আজ কোথায় দাঁড়িয়ে?

আজকের ইসরায়েল আইনস্টাইনের সেই আশঙ্কাকেই যেন সত্যি করে তুলছে। একদিকে দখলদারি, অন্যদিকে ভয়াবহ দমননীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং একচ্ছত্র শাসন। ফিলিস্তিনে একের পর এক গণহত্যা, বিশেষ করে গাজা উপত্যকায় শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা—সবই যেন এই রাষ্ট্রকে এক সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েলে চারবার নির্বাচন হলেও একটি স্থায়ী সরকার গঠন সম্ভব হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিজেকে একজন ‘মজবুত নেতা’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছেন, যিনি নাকি ফিলিস্তিনিদের ‘সন্ত্রাস’ থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু এই নীতি অনেক ইসরায়েলিই মানতে পারছেন না। অনেকেই বলছেন, রাষ্ট্রটা ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক মিত্রতাও একে একে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

একান্ত শান্তির পক্ষে দাঁড়ানো একজন বিজ্ঞানী

আইনস্টাইনের সারা জীবনজুড়ে এক কথাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল—শান্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যে ‘ম্যানিফেস্টো টু দ্য ইউরোপিয়ানস’ লিখেছিলেন, সেখানে বলা হয়েছিল, ইউরোপে রাজনৈতিক ঐক্য ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে সব দেশের একসঙ্গে মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে।

তাই তিনি কখনো ইসরায়েল সফর করেননি। কারণ তাঁর কাছে সেটি ছিল একটি ‘রাষ্ট্র’ নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের রক্ত, অশ্রু, এবং বন্দুকের নল দিয়ে গড়ে ওঠা এক সামরিক কাঠামো।

আইনস্টাইন হয়তো ভবিষ্যদ্বাণী করতে চেয়েছিলেন না, কিন্তু ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ তাঁর চিন্তাভাবনায় জায়গা করে নিয়েছিল। ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ঘিরে তিনি যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, আজ তা এক ভয়াবহ বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে।

একজন বিজ্ঞানী যখন সত্য আর মানবতার পক্ষে দাঁড়ান, তখন তাঁর কথায় থাকে অন্য রকমের ওজন। আজকের যুদ্ধ, দমন আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পৃথিবীতে আইনস্টাইনের মতো কণ্ঠগুলো আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি দরকার।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষের ঘোষণার পরই ষড়যন্ত্র শুরু: জয়নুল আবদিন

বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করার কথা বলার পরেই দেশে সংকট তৈরি করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আমার মনে হয় আপনার (প্রধান উপদেষ্টা) সবকিছু কানে না নিয়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সরকার সংসদ কায়েম করা দরক

৫ ঘণ্টা আগে

রাজসাক্ষী কাদের বলে, ইতিহাসের বিখ্যাত কয়েকজন রাজসাক্ষী

আন্তর্জাতিক আইনে এই ব্যক্তিদের ‘অ্যাকোম্প্লিস টার্নড প্রোসিকিউশন উইটনেস’ বলা হয়। ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা ভারত—প্রায় সব আধুনিক বিচারব্যবস্থায়ই রাজসাক্ষীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

১ দিন আগে

মিটফোর্ডে ব্যবসায়ীকে হত্যা, ২ যুবদল নেতাকে আজীবন বহিষ্কার

যুবদল জানায়, গত ৯ জুলাই রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের মূল ফটকে জনসমক্ষে মোহাম্মদ সোহাগ নামে এক ব্যবসায়ী যুবককে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে দায়ের করা মামলার আসামি যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টু ও ঢ

১ দিন আগে

পরিবারকে না জানিয়ে ইনুর ভয়েস রেকর্ড, জাসদের উদ্বেগ প্রকাশ

জাসদের বিবৃতিতে উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয় যে, হাসানুল হক ইনুর রেকর্ডকৃত ভয়েস কারিগরি প্রযুক্তির অপব্যবহার ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পরিবর্তন করে তার বিরুদ্ধে আইসিটি ও দেশের বিভিন্ন থানায় দায়ের করা তার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক মামলায় ফরেনসিক সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহারের অপচেষ্টা চালানো

১ দিন আগে