top ad image
top ad image
home iconarrow iconঘরের রাজনীতি

সাকি তুমি কার?

সাকি তুমি কার?
গণসংহতি আন্দোলন ও জোনায়েদ সাকি। ছবি: রাজনীতি ডটকম

আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকায় থাকা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির বর্তমান অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানের পর সাকির দলের অবস্থান অনেকের কাছেই অস্পষ্ট।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে গণসংহতি আন্দোলন সক্রিয় থাকলেও ৫ আগস্টের পর নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে দল দুটির মধ্যে কিছু মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে গণসংহতি আন্দোলনের জোট হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

এদিকে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনের মিত্র হতে গিয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সঙ্গ ত্যাগ করা এবং সংবিধান সংস্কার ও গণপরিষদ ইস্যুসহ বেশ কিছু বিষয়ে দ্বিমত থাকায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নতুন জোট গঠন উদ্যোগের সঙ্গেও গণসংহতি আন্দোলনের থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

এর মধ্যে জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতাদের বক্তব্যের সঙ্গে গণসংহতি আন্দোলন ও জোনায়েদ সাকির বক্তব্যের মিল পাচ্ছেন অনেকেই। গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরির উদ্যোগে প্রথম বৈঠকও করা হয়েছে এনসিপির সঙ্গে। তবে এ দুই দলের মধ্যে জোট গঠনের তেমন কোনো ইঙ্গিত এখনো স্পষ্ট নয়।

এ প্রেক্ষাপটেই রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল দেখা দিয়েছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জোনায়েদ সাকির রাজনৈতিক দল গণসংহতি আন্দোলনের অভিমুখ হবে কোন দিকে।

আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, জুলাই অভ্যুত্থানের পর তা অনেকটাই নড়বড়ে মনে হচ্ছে। নির্বাচনের রোডম্যাপ ও সংস্কারের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে দলগুলোতে মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যূনতম সংস্কার শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন যে দাবি উত্থাপন করেছে, তা থেকে কিছুটা ভিন্ন অবস্থানের কথা বলছে জোনায়েদ সাকির দল গণসংহতি আন্দোলন। বিশেষ করে ডিসেম্বরে নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির অনড় অবস্থানের কথা বললেও গণসংহতি আন্দোলন বলছে, ডিসেম্বরের পরেও নির্বাচন হতে পারে। তবে কী কারণে নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে পেছানো হবে, সে কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে।

Gonoshonghoti-Andolon-Vists-NCP-02-05-2025

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রথম দিন বুধবার এনসিপি কার্যালয়ে গিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। ছবি: গণসংহতি আন্দোলনের ফেসবুক পেজ থেকে

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এরই মধ্যে বৈঠক করেছে গণসংহতি আন্দোলন। ওই বৈঠকের পর ভোট ও সংস্কার নিয়ে বিএনপির সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানের পার্থক্য অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। যদিও বিএনপির কেউ কেউ এটিকে বিভাজন হিসেবে না দেখে দলটির নিজস্ব রাজনীতি ও গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হিসেবে উল্লেখ করছেন।

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পরই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে গণসংহতি আন্দোলন। সে উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত বুধবার (৩০ এপ্রিল) গণসংহতি প্রথম বৈঠকটি করেছে এনসিপির সঙ্গেই। সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার প্রশ্নে গণসংহতি আন্দোলন ও এনসিপির কিছু প্রস্তাবনা মিলে যাওয়ার পাশাপাশি ঐক্য গঠন উদ্যোগেও প্রথম এই দলের সঙ্গে বৈঠকের কারণেই কৌতূহল তৈরি হয়েছে গণসংহতি-এনসিপি জোট বা মিত্রতার সম্পর্ক নিয়ে।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে যাত্রা শুরু জোনায়েদ সাকীর। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পান তিনি। ওই বছরই তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯৯৯ সালে যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সফর ঘিরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন ও জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তিনি।

২০০২ সালের ২৯ আগস্ট গণসংহতি আন্দোলন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসেছেন তরুণ এই নেতা। ২০১৬ সালে গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও খুব ভালো ফল করতে পারেননি জোনায়েদ সাকি। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত না হওয়ায় নিজ দল গণসংহতি আন্দোলনের প্রতীকে ভোট করতে পারেননি তিনি, প্রার্থী হয়েছিলেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতীকে। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন করেও পরাজিত হয়েছিলেন তিনি।

ভোটের রাজনীতিতে ভালো ফল না করতে পারলেও জণগণের ভোটের অধিকারসহ জনজীবনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বরাবরেই সরব ছিলেন জোনায়েদ সাকি। কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পড়ে হামলা-মামলারও শিকার হয়েছেন।

পুরনো ধারার রাজনীতির বিলোপ ও নতুন বন্দোবস্তের যে রাজনীতির কথা জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের মুখে রয়েছে, জোনায়েদ সাকি ও তার দল গণসংহতি আন্দোলন বহু আগে থেকেই সে কথা বলে আসছেন। জনসম্পৃক্ত রাজনীতিকেই সবসময় গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন সাকি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘সামনে জোট কী হবে, সে প্রশ্নের চেয়ে এই মুহূর্তে আমরা সংস্কার ও নির্বাচন কীভাবে হবে তার ওপর বেশি জোর দিচ্ছি। নির্বাচনের জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রোডম্যাপ কীভাবে হবে, তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। জোট নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো আলোচনা শুরু হয়নি।’

‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে’র সঙ্গে মিললেই জোট হতে পারে জানিয়ে জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘জোট নিয়ে ভাবা হচ্ছে, কিন্তু বলার মতো কোনো অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। আন্দোলনে হোক আর নির্বাচনের জন্য হোক, ঐক্যের ক্ষেত্রে আমরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সংবাধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিকায়নের মধ্যে ভারসাম্য ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিশ্চিত করতে চাই। এ লক্ষ্য কার সঙ্গে কতটা মিলছে, তার ওপর ভিত্তি করেই আমরা ঐক্যের পরিকল্পনা করব।’

সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গণসংহতি আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বক্তব্যের অনেকটাই মিল দেখা যাচ্ছে। এসব ইস্যুতে আবার বিএনপির সঙ্গে মতাদর্শগত বড় পার্থক্য রয়েছে গণসংহতি আন্দোলনের। সে ক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে না হয়ে এনসিপির সঙ্গে গণসংহতি আন্দোলনের জোট হতে পারে কি না— এমন প্রশ্নও রাখা হয় রাজনীতি ডটকমের পক্ষ থেকে।

জবাবে জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সংস্কার-রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। সেই অবস্থানের সঙ্গে যাদের মিলবে, তাদের সঙ্গেই ঐক্য হতে পারে। সেই প্রক্রিয়াটি এখনো শুরু হয়নি। তবে ভোট-জোটের মধ্যেই আমরা সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। আমাদের রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য সবার মধ্যে একটা ঐক্য প্রয়োজন। কারণ ফ্যাসিবাদের পতন-পরবর্তী এই সময়ে আমরা সবাই মিলে যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক উত্তরণ না ঘটাতে পারি, তাহলে এক ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে। সে কারণেই আমরা জোটের রাজনীতির চেয়ে ঐক্যের রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’

গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ার সে উদ্যোগ শুরু হয়েছে বুধবার। প্রথম দিনেই জুলাই অভ্যুত্থানের পথ বেয়ে গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির সঙ্গে আলোচনা করেছে তারা।

এদিকে সংস্কার প্রশ্নে গণসংহতি আন্দোলন ও এনসিপির অবস্থানের মিল রয়েছে অনেকটাই। সেখানে গণসংহতির পুরনো মিত্র বিএনপির সঙ্গে এনসিপির অবস্থানের মধ্যে ব্যবধান ব্যাপক। বিএনপি-এনসিপি বৈরী অবস্থানের মধ্যে গণসংহতি আন্দোলনের এই পদক্ষেপ রাজনৈতিক সমীকরণে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পারে বলে মনে করছে রাজনীতি সচেতন মহল।

এর মধ্যে ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে শরিক জোট ও মিত্রদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের অংশ হিসেবে গত ২২ এপ্রিল যুগপৎ আন্দোলনের অন্যতম শরিক জোট গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে বিএনপি। সেই বৈঠকে অন্যদের সঙ্গে জোনায়েদ সাকিও উপস্থিত ছিলেন।

যুগপৎ আন্দোলনের শরিক জোট গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম দল গণসংহতি আন্দোলন ও জোনায়েদ সাকির নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে একে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ (টুকু)। রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, ‘যার যার দলীয় অবস্থান থাকবে, এটাই স্বভাবিক। ভিন্নমত থাকাটা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আন্দোলনের শরিক বলে সবাই সব বিষয়ে একমত হবে এটা আমরা মনে করি না। সেটা তো বাকশালি পন্থা। আমরা বিশ্বাস করি, মতপার্থক্য নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলো বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য গড়ে তুলতে পারে।’

অন্যদিকে বাম গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ধারার দলগুলোকে নিয়ে নতুন জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সিপিবি-বাসদসহ বাম ঘরানার কয়েকটি দল। সেখানে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও নাগরিক ঐক্যের মতো দলগুলোর সঙ্গেও প্রাথমিক পর্যায়ের কথা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে সংবিধান সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচনের মতো ইস্যুগুলো নিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের সঙ্গে সিপিবি-বাসদসহ বাম দলগুলোর মতবিরোধ রয়েছে। তাই গণসংহতি আন্দোলনকে নতুন এই জোটে দেখার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

এ প্রসঙ্গে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে জোট গঠনের সম্ভাবনা কম। কারণ তাদের নিজস্ব যে রাজনীতি, তা আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট না। সংবিধান পুনর্লিখন, চার মূলনীতি পরিবর্তন, দেশের নাম পরিবর্তন— এসব বিষয়ে আমরা একমত না। এগুলো প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করার কৌশল হিসেবে আমরা দেখি।’

নাম উল্লেখ না করেও গণসংহতি আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘যে গ্রুপের কথা আপনি বলছেন সে গ্রুপের কেউ কেউ দেখি তারা এসবের সমর্থক। তবে এই গ্রুপের কোনো কোনো দলের সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে।’

r1 ad
top ad image