রাজনীতি

পিআর নির্বাচন পদ্ধতির ভালো-মন্দ

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ১৪: ৩৩

নির্বাচন প্রতিটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণ। আর এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া কেমন হবে, তা নির্ভর করে নির্বাচন পদ্ধতির ওপর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নির্বাচন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো “প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন” বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি, যেটি সংক্ষেপে পরিচিত পিআর পদ্ধতি নামে। এই পদ্ধতিতে জনগণের দেওয়া ভোটের অনুপাতে দল বা প্রার্থীদের আসন বণ্টন করা হয়। অনেক দেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে এটি স্থিতিশীলতা ও ন্যায়ের এক সম্ভাব্য উপায় হিসেবে বিবেচিত হলেও, এর কিছু দুর্বল দিকও রয়েছে। ফলে একে একপাক্ষিকভাবে ভালো বা খারাপ বলা যায় না—বরং এটি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়নের বিষয়।

প্রচলিত একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতির তুলনায় পিআর পদ্ধতি ভিন্নভাবে কাজ করে। এখানে জনগণ সরাসরি কোনো ব্যক্তিকে ভোট না দিয়ে একটি দল বা তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের ভোট দেয়। দলের মোট ভোটের অনুপাতে তারা আসন পায়। যেমন, যদি কোনো দল মোট ভোটের ৩০ শতাংশ পায়, তবে তারা সংসদের ৩০ শতাংশ আসনে প্রতিনিধিত্ব পাবে। এই পদ্ধতি ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটায় বলে একে অনেকেই ‘ন্যায়ভিত্তিক’ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হিসেবে দেখেন।

এই বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ড. ডেভিড ফারেল বলেন, “পিআর পদ্ধতি জনগণের ভোটকে বেশি সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে। এতে বড় দলগুলোর একচেটিয়া ক্ষমতা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং ছোট দলগুলোকেও কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়।” তাঁর মতে, এটি বহুদলীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা সমাজের অবহেলিত অংশগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়।

অনেক ইউরোপীয় দেশ—যেমন নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, জার্মানি—পিআর পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। এই দেশগুলোতে সংসদে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকে এবং সরকার গঠনে জোট বাধার প্রয়োজন হয়। এই পরিস্থিতিতে একটি দল এককভাবে স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না—বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন পড়ে, যা গণতন্ত্রকে অধিক অংশগ্রহণমূলক করে তোলে।

তবে পিআর পদ্ধতির এমন ভালো দিকের পাশাপাশি কিছু বাস্তব সমস্যা আছে, যা অনেক সময় এই পদ্ধতিকে জটিল করে তোলে। বিশেষ করে, অনেক বেশি দল সংসদে আসলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। কোনো একটি দলের পক্ষে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে, যার ফলে সরকার গঠনে জোট বাধতে হয়। এই জোট অনেক সময় স্বার্থের সংঘাতে ভেঙে পড়ে, যার ফলে বারবার নির্বাচন, অস্থির সরকার ও নীতিনির্ধারণে স্থবিরতা তৈরি হয়।

এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক ড. সারা ওয়েন মন্তব্য করেন, “পিআর পদ্ধতি রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ ঘটালেও, তা কখনো কখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতি কমিয়ে দেয়। একটি বিল পাস করতে অনেক দলের সঙ্গে সমঝোতার প্রয়োজন হয়, যার ফলে সংস্কারমূলক নীতিমালাও আটকে যেতে পারে।” তাঁর মতে, এই পদ্ধতি সমঝোতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে বটে, তবে সেটি অনেক সময় দেরি করে পৌঁছায় জনগণের দরজায়।

আরও একটি সমালোচনার বিষয় হলো, পিআর পদ্ধতিতে অনেক সময় এমন লোকও সংসদ সদস্য হয়ে যান, যাঁরা নিজ এলাকা বা জনগণের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। কারণ এই পদ্ধতিতে প্রার্থীরা কেন্দ্রীয়ভাবে নির্ধারিত তালিকা থেকে নির্বাচিত হন। ফলে জনতার সরাসরি সম্পর্ক বা জবাবদিহির সম্পর্ক কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই ধরনের প্রতিনিধিত্ব কখনো কখনো জনগণের বিচ্ছিন্নতা বাড়ায়।

তবে পিআর পদ্ধতির সবচেয়ে বড় অবদান হতে পারে অন্তর্ভুক্তিমূলকতা। নারী, সংখ্যালঘু, আদিবাসী কিংবা প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি নির্বাচনে এটি এক সম্ভাব্য পথ খুলে দেয়। কারণ, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার পদ্ধতিতে এসব গোষ্ঠী অনেক সময় হারিয়ে যায়; বড় দল বা জনপ্রিয় প্রার্থীই কেবল সুযোগ পান। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে দল চাইলে এসব গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের তালিকায় যুক্ত করে সংসদে পৌঁছে দিতে পারে।

বিশ্বব্যাপী পিআর পদ্ধতির সফল উদাহরণ হিসেবে জার্মানির কথা বলা যায়। সেখানে মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতি চালু রয়েছে—যেখানে একদিকে একক আসনে প্রার্থী নির্বাচন হয়, অন্যদিকে তালিকা ভিত্তিক পিআর পদ্ধতিও রয়েছে। এই ভারসাম্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকে আরও সুষম করে তোলে। আবার ভারতের রাজ্যসভা ও বাংলাদেশের সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রে কিছুটা অনুরূপ পদ্ধতির ব্যবহার দেখা যায়, যদিও তা পুরোপুরি পিআর নয়।

ad
ad

ঘরের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

নির্বাচনে যাদের ভরাডুবি হবে তারাই পিআর পদ্ধতি চায়: প্রিন্স

এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, নেতাকর্মীদের যারাই অসৎ পথে পা দেবে, সে যত শক্তিশালী, জনপ্রিয়, ত্যাগী বা নিবেদিতপ্রাণই হোক না কেন, বিএনপি পরিবারে তার ঠাঁই হবে না। রাজনীতি নয়, দেশ ও জনগণকে দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে নেতাকর্মীদের রাজনীতি করতে হবে।

৬ ঘণ্টা আগে

জামায়াত একদিকে মনোনয়ন দিচ্ছে, আরেক দিকে ভোট পেছানোর দাবি করছে: রিজভী

রিজভী বলেন, ‘জনগণের মনোভাব বুঝতে জামায়াতের ইতিহাসই ব্যর্থ। ১৯৭১ সালে তারা যদি জনগণের মন বুঝত, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করত না। তারা ১৯৮৬ সালে এরশাদের অধীনে শেখ হাসিনার সঙ্গে নির্বাচনে যেত না। তারা সব সময় জনগণের মতামত উপেক্ষা করেছে। আসলে তাদের কাছে জনগণই কোনো বিষয় নয়।’

৬ ঘণ্টা আগে

সীমান্তের আগ্রাসন আর মেনে নেব না: নাহিদ

রাজনৈতিক দলগুলোকে বৈষম্য করার সুযোগ দেওয়া হবে না জানিয়ে নাহিদ বলেন, ‘দেশে মৌলিক সংস্কার করতে হবে। সব জেলা থেকে বৈষম্য দূর করতে হবে। আমরা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চাই। সেই স্বপ্নই আমরা দেখি। জনগণের বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের নিকট আমানত। নতুন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোকে বৈষম্য করার সুযোগ দেওয়া হবে ন

৭ ঘণ্টা আগে

'পিআর পদ্ধতি নিয়ে কমিশনে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুই হয়নি'

বিএনপিকে সংস্কারের বিষয়ে আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বড় অন্যায় উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘খুব চিন্তাভাবনা করে বড় পরিবর্তন করতে হয়। কোনো বিশেষ দলের সুবিধার জন্য পরিবর্তন চাওয়া ঠিক নয়। জনগণের স্বার্থেই সংস্কার করতে হবে।’

৯ ঘণ্টা আগে