নগরভবন টানাপোড়েনের ধাক্কা ক্ষমতার গদিতে কি আঁচড় ফেলবে?

শাহরিয়ার শরীফ
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ১০: ৫১
বৃহস্পতিবার কাকরাইল মোড়ে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উপস্থিত হন ইশরাক হোসেন। ছবি: ফোকাস বাংলা

ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানো-না পড়ানো নিয়ে বিএনপি প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে। মেয়র পদের মতো ‘ছোট’ একটি ইস্যুতে বিএনপি কেন এতটা অনড়, আর সরকারই বা কেন নজির থাকা সত্ত্বেও ইশরাকের ব্যাপারে ভিন্ন অবস্থানে— এসব নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত।

আপাতদৃষ্টিতে ছোট মনে হলেও ইশরাকের শপথ ইস্যু ঘিরে এই আন্দোলন আগামী দিনগুলোতে বিএনপি ও সরকারের অবস্থান নির্ধারণ করে দেবে বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদ ও রাজনীতি নিয়ে ভাবেন এমন বিশ্লেষকরা।

সরকারের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যেই রাজপথের এই আন্দোলনে জয় নিয়ে আপাতত ঘরে ফেরার অপেক্ষায় বিএনপি। দলটি মনে করছে, আগামী রোববারের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়াতে সরকার বাধ্য হলে বিএনপিকে আগামীতে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। প্রায় ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি এবার হয়তো ক্ষমতার স্বাদ পাবে।

বিএনপি যখন ফুরফুরে তখন ক্ষমতায় থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা মনে করছেন, ডিএসসিসিতে বিএনপি নেতা ইশরাকের মেয়র হিসেবে বসে যাওয়াটা তাদের এবং সরকারের অন্যতম সহায়ক শক্তি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দুর্বলতা হিসেবে দেখতে পারে সাধারণ মানুষ। এতে সরকার পরিচালনা ও রাজনীতির মাঠে এনসিপি লম্বা সময় টিকে থাকার ক্ষেত্রে হোঁচট খেতে পারে।

বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালত এক রায়ে বলেছেন, ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ পড়াতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু দুদিন আগেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও ইশরাক হোসেন একে অন্যকে দোষারোপ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

ইশরাক হোসেন রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘দেখুন, এটি দুঃখজনক যে আমাকে রাজপথে নামতে হয়েছে। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। সরকারেরই দায়িত্ব ছিল আমাকে শপথ পড়ানো। চট্টগ্রামে এমনটা তো হয়েছে। তাহলে এখানে কেন বিমাতাসুলভ আচরণ? মানে তারা কি বিএনপিকে ফেলনা ভেবেছে? ন্যায্য দাবিতে বিএনপি সবসময় জনগনের পাশে থেকে কাজ করেছে। শপথ নিয়ে টালবাহানা করা হলে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে তার জন্য সরকারই দায়ী থাকবে।’

তবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা আলাপকালে বলেন, সবকিছু সরকারি সিদ্ধান্তে হয় না। অনেক কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেও হয়। দক্ষিণের মেয়র পদে ঘটনাটি রাজনৈতিক। সরকার সিদ্ধান্ত নিলে তো রায় অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিত। তার দাবি সরকার আদালত অবমাননা করেনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জুলাই অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বেশকিছু বিষয়ে বিএনপির মতপার্থক্য থাকলেও সরাসরি সরকারের বিরোধিতা করা বা আন্দোলনের পথে হাঁটেনি বিএনপি। মূলত ইশরাকের মেয়র ইস্যুকে কেন্দ্র করেই প্রথমবারের মতো রাজপথে সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিলো দলটি। তাই অনেকেই এটাকে নিছক মেয়র পদে বসানোর আন্দোলন হিসেবে দেখছেন না। এর ফলাফলের মধ্য দিয়েই বোঝা যাবে আগামী দিনের রাজনীতিতে কারা এগিয়ে থাকবে— বিএনপি নাকি অন্তবর্তীকালীন সরকার ও তার মিত্র রাজনৈতিক শক্তি?

ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র পদে শপথের মাধ্যমে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে সপ্তাহখানেক আগে আন্দোলনে নামেন তার সমর্থকরা। তারা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বসানোর সিদ্ধান্ত নিতে সময়সীমা বেঁধে দেন।

Supporters-Of-Ishraq-Hossain-At-Motsho-Bhaban-22-05-2025

ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে কর্মী-সমর্থকরা আগের কয়েকদিনের মতো বৃহস্পতিবারও রাজধানীতে বিক্ষোভ করেন। ছবি: ফোকাস বাংলা

গত মঙ্গলবারের মতো আন্দোলন সমাপ্ত ঘোষণা করার আগে আন্দোলনকারীরা বলেছেন, বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে দাবি মানা না হলে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হবে। এর মধ্যেই আদালতের রায় পেয়ে গেছে সরকার। এখন বল সরকারের কোর্টে।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, ‘অতি অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে আদালত ঘোষিত ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে শপথ গ্রহণ করানোর ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় ঢাকার এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আরও বৃহৎ আন্দোলন হতে পারে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘আমরা এটি দেখছি যে সরকার কী করে। তার বিপরীতে আমরা কর্মসূচি নেব। এখানে ছাড় হবে না।’

তার দাবি, সরকার ও তার সমর্থিত দল এনসিপি কিছু দিন ধরেই বিএনপিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। এটা তার আর বাড়তে দেবেন না। শক্তি দেখাবেন।

এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন ঘেরাওয়ে এনসিপির কতজন ছিল? তাদের জনবল কমছেই। বিএনপি আর ছাড় দেবে না। মেয়র ইস্যুর মাধ্যমে এটার শুরু বলা যেতে পারে।’

বেশ কিছু দিন আগে থেকেই সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে কথা বলতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে নির্বাচন ও ভোটাধিকার নিয়ে সরকারের সমালোচনা শুরু করেছেন বিএনপি নেতারা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে ‘কালো ছায়া’ পড়েছে। জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ‘পাঁয়তারা’ শুরু হয়েছে। সরকার বিভিন্ন ইনস্টিটিউশনগুলোকে পরস্পরের মুখোমুখি করার একটা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত শুরু করা হয়েছে। আমরা দেখতে পারছি যে কিছু মানুষ, যারা সরকারের মধ্যে অনুপ্রেবশ ঘটিয়ে বাংলাদেশকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে।

বিএনপি এখন আন্দোলন করছে উপদেষ্টা পরিষদের দুই ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীবের পদত্যাগ চেয়ে। অন্যদিকে এনসিপির দাবি উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সালেহউদ্দীন আহমেদ ও আসিফ নজরুলের পদত্যাগ। ছাত্রদের দল এনসিপি আরও চাইছে, উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্র প্রতিনিধিরা থাকবে এবং তাদের সংখ্যা বাড়বে।

বিএনপির এক নেতা বলছেন, ছাত্রদের দল অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। এরা সরকারে ও দল গঠনে ব্যর্থ— এটা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চাইছে বিএনপি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, সরকার বা এনসিপি মনে করছে, ‘এই মুহূর্তে মেয়র পদটি যদি ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে বিএনপির রাজনীতি ঢাকায় শক্তিশালী হয়ে যাবে। যেকোনোভাবেই এই জায়গাটাকে ডিল করে তারা এমন একটি জায়গায় নিয়ে যেতে চায় যখন আর মেয়াদ থাকবে না।’

অধ্যাপক সাব্বির আরও বলেন, ‘মেয়র ইস্যুটাকে বিএনপি একটা প্লট হিসেবে দেখতে পারে। তবে আমার মতে, বিএনপি যদি এটাকে প্লট হিসেবে নেয় তাহলে জনগণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি এই মুহূর্তে সম্ভব কি না সেটা হচ্ছে বিষয়। কারণ বিএনটি সেই সময় এই নির্বাচনকে প্রত্যাখান করেছিল। তবে বিএনপির এ অবস্থানের পেছনে ভিন্ন মোটিভ থাকতে পারে। সেদিক থেকে সরকারও এটাকে দীর্ঘায়িত (লিংগার) করতে চাইছে।’

বিএনপি ও সরকার দুপক্ষই দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে উল্লেখ করে এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘বিএনপি সরকারের সব কাজকে সমর্থন দিতে পারছে না, আবার সরকারের বিরুদ্ধেও যেতে পারছে না। সরকার আবার এই ডিলেমাকেও কাজে লাগাতে চাইছে। সরকার চাইছে না যে বিএনপি ঢাকায় শক্তি সঞ্চয় করুক এবং তার নিজের কর্তৃত্ব খর্ব হোক।’

আগামী দিনের রাজনীতিতে ইশরাকের মেয়র পদে শপথ ইস্যুর প্রভাব নিয়ে অধ্যাপক সাব্বির বলেন, ‘বিএনপি যদি তার এই দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে তাহলে সরকার ভেবে নেবে যে নির্বাচন-সংস্কারসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপির অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে। অন্যদিকে বিএনপি মনে করছে, এই দাবির মধ্য দিয়ে তার ভবিষ্যত রাজনৈতিক দাবিগুলোও প্রতিষ্ঠিত করতে সরকারকে বাধ্য করতে পারবে। বিএনপির আগামী দিনের দাবি আদায়ের রাজনীতিতে তাই এই আন্দোলনের একটা প্রভাব থাকবে।’

ad
ad

ঘরের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ড. ইউনূসের পদত্যাগ তার ব্যক্তিগত বিষয়, বিএনপি দাবি করেনি : সালাউদ্দিন

তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা না করে যদি তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান, সেটিও তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে একান্তই যদি তিনি দায়িত্ব পালনে অপারগ হন, তাহলে রাষ্ট্র তো বসে থাকবে না। রাষ্ট্র নিজ দায়িত্বে বিকল্প ব্যবস্থা নেবে।’

৯ ঘণ্টা আগে

আপনার পদত্যাগ চাই না— অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি ফারুক

জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘আপনার মতো সচেতন নাগরিক, যিনি বিশ্বের দরবারে আমাদের গর্বিত করেছেন, আপনি নোবেলজয়ী। আপনি ব্যক্তিগত ইউনূস নন, আপনি জনগণের। আপনি বলেছেন পদত্যাগ করতে চাই, এসব দেখে আমার মন খারাপ হয়েছে। ড. ইউনূস, আপনি এই দেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন, আমরা আপনার পদত্যাগ চাই না।’

৯ ঘণ্টা আগে

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না: বিশেষ সহকারী

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘আমি মনে করি, সরকারকে এখন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে আলোচনায় বসতে হবে। নিয়মিত বসে এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত চাইতে হবে। কোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতা কাম্য নয়।’

১৩ ঘণ্টা আগে

দায়িত্ব পালন করতে পারছি কি না, এটিই চাপ: রিজওয়ানা

উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, শুধু নির্বাচনের জন্য বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়নি। কাল (বৃহস্পতিবার) উপদেষ্টা পরিষদের সভার পর অনেক সময় আমরা আলোচনা করেছি। আমাদের তিনটি কঠিন দায়িত্ব- এর একটি সংস্কার, অন্যটি বিচার, আরেকটি নির্বাচন। শুধুমাত্র নির্বাচন করার জন্যই আমরা দায়িত্বটা নেইনি। আমাদের আরও দুটি দায়ি

১৪ ঘণ্টা আগে